বনের পাখি মিটু জয় করেছে সবার হৃদয়
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
২২ জুলাই রবিবার স্নেহাষ্পদ সাংবাদিক বকুল রহমানের চাটমোহর জিরো পয়েন্ট এলাকায় অবস্থিত মেডিসিনের দোকানে বসে আড্ডা দেবার সময় বোঁথর গ্রামের মৃত আলতাব হোসেনের ছেলে লিয়াকত হোসেন লিটন এসে যোগ দেয় আমাদের আড্ডায়। লিটনের কাঁধে তখন একটি টিয়া পাখি। আমাদের কথার ফাঁকে ফাঁকে লিটন তার টিয়া পাখিটির সাথে কথা বলছিল। বার বার আদর করছিল। চুমু খাচ্ছিল। মাঝে মধ্যে মিটু মিটু বলে ডেকে টিয়া পাখিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করছিল। মিটুও সারা দিচ্ছিল লিটনের ডাকে। প্রসঙ্গ ক্রমে মিটুই হয়ে ওঠে আমাদের আড্ডার প্রধান আলোচ্য বিষয়।
মিটু প্রসঙ্গে বকুল রহমান বলেন, “বছর তিনেক পূর্বে আমার বন্ধু জুয়েল এবং আমার একটি পাখির খামার ছিল। দেশী প্রজাতির পাখি ধরা ও সংরক্ষণ আইনত দন্ডনীয় অপরাধ হওয়ায় বিদেশী যে সকল পাখি আমাদের দেশে পালন বৈধ আমরা সেসকল পাখির খোঁজ করতে থাকি। এক সময় বগুড়ার চান্দু মিয়া ষ্টেডিয়ামের পাশে একটি পাখি বিক্রির দোকানে গিয়ে পাকিস্তানী এক দেড় মাস বয়সী এক জোড়া টিয়া পাখির সন্ধান পাই। এ টিয়া জোড়া আমাদের সাথে কথা বলবে দোকানী এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় জুয়েল ও আমি ৭ হাজার টাকার বিনিময়ে পাখি জোড়া কিনে আনি এবং চাটমোহর উপজেলা গেটের সামনে অবস্থিত জুয়েলের খামারে অন্যান্য পাখির সাথে পালন শুরু করি।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা এর নাম রাখি মিটু। কয়েক দিনের মাথায় মিটুর সঙ্গিনী হঠাৎ করে মারা গেলে আমরা শোকাহত হই। মিটুও একা হয়ে পরে। আমরা মিটুর সঙ্গিনী খোঁজার চেষ্টা করি। কিন্তু অন্য কোন টিয়াকে মিটু তার সঙ্গিনী হিসেবে জোড় বাঁধেনি। মিটু তখন থেকেই আমাদের পাশে থাকতে স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। জুয়েল এবং আমিও মিটুকে আমাদের কাছা কাছি রাখি। মিটুকে ছেড়ে দিলেও ও উড়ে যায় না। মিটু সব সময় মুক্ত অবস্থায় থাকলেও নীল আকাশ বন বনানী মিটুকে আকৃষ্ট করেনা হয়তো। আমরা মিটুকে সূর্যমুখীর বীজ চিনা কাউন ধান আপেল পেয়ারা আঙ্গুর কলা পেঁপে খাওয়াই। রোগ ব্যাধিতে চিকিৎসা করাই। মিটুর সাথে আমাদের ভালোই কাটছিল। জুয়েল বাড়ির নিচতলার খামারেই পালিত হচ্ছিল মিটু। বছর খানেক পূর্বে জুয়েল অসুস্থ হলে মিটুর দেখাশুনা করতে পারছিল না। তখন আমি মিটুর দায়িত্ব নেই। মিটুকে খাবার দিলে নিজে খেত না। ওকে মুখে তুলে খাওয়াতে হতো। রাত ১২ টা ১ টার আগে ঘুমাতো না। কিছু দিন পর ব্যবসায়িক কাজ কর্মে আমার ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় আমার পক্ষেও অনেক সময় মিটুর দেখাশুনা করা কঠিন হয়ে পরে। এ বিষয়টি প্রকাশ হওয়ায় জানতে পেরে পাখি প্রেমিক লিটন মিটুকে পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে। লিটন সঠিকভাবে মিটুর রক্ষণাবেক্ষণ করবে এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় বছর খানেক আগে মিটুকে লিটনের কাছে হস্তান্তর করি। সেই থেকে মিটু লিটনের কাছে আছে।”
মিটু প্রসঙ্গে লিটন বলেন, “পাখির প্রতি অগাধ ভালোবাসা থেকেই মিটুর দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেই। বিভিন্ন সুরে পরিষ্কার বাংলায় মিটু যখন আমার সাথে কথা বলে তখন মুগ্ধ হই। অবাক হয় মানুষ। অপরিচিত মানুষ দীর্ঘ ক্ষণ মিটুর সাথে কাটানোর পর তবেই মিটু তার সাথে কথা বলে। আমার বাড়ির সামনে দিয়ে লোকজন যাবার সময় স্কুলের ছাত্র ছাত্রীরা যাবার সময় মিটুকে ডাকে। আমি যখন বাড়ি থেকে কোথাও বের হবার প্রস্ততি নিতে থাকি তখন আমার সাথে বের হবার জন্য মিটু ডাকাডাকি শুরু করে। গোছলের জন্য পানির কল ছেড়ে দিলে মিটু নিজের ইচ্ছে মত পানিতে নিজের শরীর ভিজিয়ে নেয়। আমার ছোট ছেলে রাতুল, ছোট ভাই লিমন এবং আমার স্ত্রী শাপলা ও মিটুর দেখাশুনা করে।”
লিটনের চাচা ইদ্রিস আলী বলেন, “মিটু যেন আমাদের মনের কথা বোঝে। আমাদের আদর করে। ভালোবাসে। মিটুকে আমি ও অনেক সময় দেই।”
বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে একথা সত্য হলেও বনের পাখিও আদর ভালোবাসা পেলে সে যে প্রতিদানে কতটা ভালোবাসা দিতে পারে তা মিটুকে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। ভালোবাসার বিনিময়ে যে ভালোবাসা পাওয়া যায় মিটু তার অন্যতম প্রমাণ।