এসো গাই তারুণ্যের জয়গান
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
‘সৃষ্টিতে তুমি, নতুনে তুমি। তোমার উদ্দীপনায় সুন্দর হয়ে উঠে আমার এ জন্মভূমি।’ হ্যাঁ আমি আমাদের দেশের তরুণদের কথাই বলছি। যুগে যুগে ভাল’র জন্য যা কিছু পরিবর্তন হয়েছে, তার মূলে আছে আমাদের তরুণ সমাজ। ৫২’র ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৮’র নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছে নবীন কাণ্ডারিগণ। তাঁদের সৃজনশৈলী চিন্তা, দৃঢ় মনোবল আর সুকঠিন পদচারণায় বার বার আমরা জিতেছি। আমাদের ইতিহাস লেখা হয়েছে তাঁদেরই সাহসিকতায়।
নেত্রকোনা সদরের ছোট্ট একটি গ্রাম লক্ষ্মীগঞ্জ। এই গ্রাম আয়তনে ছোট হলেও এখানে নানা পেশাজীবী মানুষের বাস। বিভিন্ন ধরণের কাজের পাশাপাশি এখানে সংস্কৃতিমনা মানুষেরও অভাব নেই। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি খেলা, নাটক, গান এগুলোও চলে সমান তালে। ২০১৩ সালে ব্যাডমিন্টন খেলাকে কেন্দ্র করে লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নসহ এর আশপাশের ৮টি (চকপাড়া, আতকাপাড়া, বাইশদার, কাওয়ালীকোনা, গদাইকান্দি, লক্ষীগঞ্জ, বিরামপুর ও মদনপুর) গ্রামের ১৬জন যুবক মিলে একটি দল গড়ে তোলে। এই দলের সদস্যরা প্রতিবছরই ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে খেলায় অংশ নিতো। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো অনুষ্ঠানে ভলান্টিয়ারের কাজ করতো। এভাবে তাঁরা প্রত্যেকেই খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠে। তাঁদের বন্ধুত্বের কারণে এলাকায় তাঁরা পরিচিতি লাভ করে। ফলে এলাকার কোনো উৎসব আয়োজনেও তাঁদেরকে সবাই দাওয়াত দিতো। তাঁদের এই বন্ধুত্বের নাম দিতেই তাঁরা ১৬জন মিলে একটি সংগঠন গড়ে তোলে। যা বর্তমানে ‘বন্ধু মহল’ নামে পরিচিত।
২০১৫ সাল থেকে এই ‘বন্ধু মহল’ অত্র ইউনিয়নসহ এর আশেপাশের অন্যান্য ইউনিয়নের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সমাপনী পরীক্ষার্থীদের নিয়ে একটি প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। যা ‘বন্ধু মহল-শিক্ষাবৃত্তি’ নামে পরিচিত। এই প্রতিযোগিতায় পাঠ্য বই থেকে ১০০ নম্বরের একটি প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয়। যার বেশিরভাগ থাকে সঠিক উত্তর দেয়া। ক, খ, গ, ও ঘ এই চারটি সেটের প্রশ্ন তৈরি করা হয়। পরে লটারীর মাধ্যমে পরীক্ষার জন্য প্রশ্ন বেছে নেয়া হয়।
এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। সমাপনী পরীক্ষা শেষ হয়েছে ২৬ নভেম্বর ২০১৮ইং তারিখে। আর ‘বন্ধু মহল-শিক্ষাবৃত্তি’ পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ৩০ নভেম্বর। লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের ১২টি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি নেত্রকোনা সদরের আরো ১৪টি (মোট ২৬টি) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থী এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে। এর মধ্য থেকে ২০জন শিক্ষার্থীকে মেধা তালিকা অনুসারে নির্বাচন করা হয়েছে।
পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল লক্ষ্মীগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়। সকালে পরীক্ষার পর বিকালে শুরু হয় আলোচনা অনুষ্ঠান ও পুরষ্কার বিতরণ। উক্ত অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন নেত্রকোনা জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক জনাব মীর্জা শাকিলা বিন হাসিন। এছাড়াও উপস্থিত ছিলেন অত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষক এ.টি.এম এখলাছুর রহমান, হাজী ফয়েজ উদ্দিন আকন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আজহারুল হক তুহিন, ৬নং লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান শফিকুল কাদের সুজাসহ এলাকার বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, সমাজসেবক, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক কর্মী, শিক্ষার্থীদের অভিভাবক ও আরো অনেকে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক বলেন, ‘যুবকরাই আমাদের ভবিষ্যৎ। তাঁরা সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তাঁরা সাহসী। তাঁরা লেখাপড়ার পাশাপাশি কোমলমতি শিক্ষার্থীদের সোনালি ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে যে ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেই উদ্যোগকে আমি সাধুবাদ জানাই। ভবিষ্যতে যে কোনো ধরণের কাজে আমি যতটুকু সম্ভব তাঁদের সহযোগিতা করবো’। তিনি আরো বলেন, ‘মায়েদের জন্যই আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আজকে সারাদিন মায়েরাই তাদের সন্তানদের নিয়ে শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের মেধা আছে, স্পৃহা আছে, এর পরিচর্যা করতে হবে। তাঁদেরকে উচ্চ শিক্ষার জন্যও অনুপ্রাণিত করতে হবে। তবেই তারা মানব সম্পদে পরিণত হবে।’ এরপর তিনি নেত্রকোনা জেলায় পরিচালিত শিক্ষা কেন্দ্রিক বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোকপাত করেন।
আলোচনা শেষে বিজয়ীদের হাতে একটি করে ক্রেস্ট ও নগদ দুই হাজার টাকা প্রদান করা হয়। সর্বোচ্চ ৯৪ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অর্জন করে লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের আতকাপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জান্নাতুল সাদিক শোভা। উপস্থিত সকল আলোচকগণ বন্ধুমহলের এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রসংশা করেন। পড়ালেখার পাশাপাশি খেলাধূলা ও সুস্থ বিনোদন চর্চাতেও যেনো শিক্ষার্থীরা সমানভাবে দক্ষতা অর্জন করতে পারে সেজন্য আলোচকগণ অভিভাবকদের দৃষ্টি দিতে বলেন।
স্থানীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘বন্ধন’ এর সভাপতি মহোদয় বন্ধুমহলের প্রতি মাসে সভা করার জন্য তাঁর সভাকক্ষ ব্যবহার করার অনুমতি প্রদান করেন। কারণ তাঁদের মাসিক সমন্বয় সভা করার জন্য নির্দিষ্ট কোন জায়গা নেই। তাই তাঁরা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহোদয়ের কাছে এ বিষয়ে অনুরোধ করেন। যতদিন পর্যন্ত তাঁদের বসার স্থানের ব্যবস্থা না হয় ততদিন তাঁরা বন্ধন সাংস্কৃতিক সংগঠনের সভাকক্ষ ব্যবহার করতে পারবেন।
বর্তমান সময়ে যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলছে আমাদের যুব সমাজ। যা কিছু সুন্দর, সকলেই তা গ্রহণ করছে না। কেউ বিপথেও যাচ্ছে। তবে বন্ধু মহলের প্রতিটি সদস্য নিজেরাই যেখানে শিক্ষার্থী, তাঁদের এ ধরণের আয়োজন এলাকায় অনেকের কাছেই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে ও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সম্পদশালী মানুষেরা অর্থ থাকা স্বত্তেও যে কাজ করার কথা চিন্তাও করে না, আমাদের যুবকেরা তা করে দেখিয়েছে। তাদের অগ্রযাত্রায় বারসিকও শামিল থেকে তাদের কাজকে এগিয়ে নিতে সহযোগিতা করবে বারবার।