ফুলতারার গর্ব তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
মানিকগঞ্জের বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. বছির উদ্দিনের উদ্দিনের স্ত্রী ফুলতারা। তিনি অত্যন্ত কাছ থেকে দেখেছেন স্বাধীনতা প্রত্যাশী মুক্তিযোদ্ধাদের অমিত বিক্রম এবং আত্মত্যাগের গৌরব। তার স্বামী তাদেরই একজন।
মুক্তিযোদ্ধা বছির উদ্দিনের স্ত্রী ফুলতারার সাথে কথা হয় বানিয়াজুরীর রাথুরা গ্রামে তার বড় মেয়ে রিজিয়া বেগমের বাড়িতে। বয়সের ভারে আর নানা রোগ-শোকে কাতর সত্তরোর্ধ্ব এই নারী। একাত্তরের অনেক ঘটনা, তার স্বামীর মুক্তিযুদ্ধে যোগ, মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য হওয়ায় যুদ্ধের সময় পালিয়ে বেড়ানো এবং চরম দারিদ্রতায় শিশু কন্যা নিয়ে তার বেঁচে থাকার সেই কষ্টকর দিনগুলোর কথা স্মরণ করতেই তরতর করে জল বেয়ে ভিজে গেল তার বয়সী কোটরাগত চোখদুটো।
আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলতে লাগলেন, ‘চারিদিকে গন্ডগোল (যুদ্ধের দামামা)। সবারই মনে অজানা আতঙ্কে। যে যার মতো পরিবার পরিজন নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটছে। আমার শশুর-শাশুড়ি অনেক আগেই মারা গেছেন। বাড়িতে আমার স্বামী আর ৫ বছরের মেয়ে রিজিয়া। অভাবের সংসার। অল্প কৃষি জমি আর স্বামীর উপার্জনে কোনমতে চলছিল সংসার। এরই মাঝে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। একদিন মাঝরাতে আমার স্বামী কানে ফিসফিস করে বললো, শোনো-আমি যুদ্ধে যাচ্ছি। দেশ স্বাধীন করেই তবে ঘরে ফিরবো। কেউ জিজ্ঞেস করলে কিছু বলো না। আর যদি মরে যাই, মনে দুঃখ নিও না। দেশের জন্য জান দেবার ভাগ্য সবার হয় না। এরপর ঘুমন্ত মেয়ের কপালে চুমা দিয়ে তিনি আস্তে আস্তে ঘরের বাইরে গেলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার কান্না শুনে মেয়েটির ঘুম ভেঙ্গে গেল। গলা জড়িয়ে ধরে মেয়ের সে কি কান্না। স্ত্রী-সন্তান, পরিবার আর আমাদের চোখের পানি তার পথ আটকাতে পারেনি। তিনি মুক্তিযুদ্ধে গেলেন। কয়েক মাস তার কোন হদিস ছিল না। যখন শুনতাম অমুন জায়গায় এক মুক্তিযোদ্ধার লাশ পাওয়া গেছে। তখন বুক ফেটে কান্না আসতো। এই বুঝি তার মৃত্যুর খবর আসে। একবার খবর আসে আমার স্বামী যুদ্ধে মারা গেছে। তখন ওই শিশুকন্যা এসে বুকে জড়িয়ে ধরে বাবা বাবা বলে কান্না শুরু করে। তিনদিন নাওয়া খাওয়া করতে পারিনি।’
ফুলতারা বলেন, ‘একদিকে অভাবের তাড়না আর অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য। আমার স্বামীর খোঁজে রাজাকারদের রক্তচক্ষু আর হুমকিতে শিশু মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি দিনের পর দিন। উপার্জনক্ষম ব্যক্তি নিখোঁজ থাকায় পরিবারে নেমে আসে সীমাহীন দুর্ভোগ। কোন উপায়অন্ত না পেয়ে আমার শশুর বাড়ি থেকে ৮/১০ কি.মি. দূরে কাটিগ্রামে আমার পিতার বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিই। দরিদ্র পিতা হাইজা বেপারীর কোন কাজ ছিলনা তখন। পরিবারের সদস্য সংখ্যাও বেশি। অভাব-অনটনে মানবেতর জীবন কাটছে তাদের। অন্যের বাড়ি কাজ করে তাদেরকে একবেলা খাওয়ালেও দু’বেলা না খেয়ে কাটাতে হয়েছে।’
তিনি বলেই যাচ্ছেন, ‘এরপর চারিদিকে মানুষ আনন্দ করছে। দেশ স্বাধীন হইছে… ওইদিন গভীর রাতে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মেয়ের নাম ধরে ডাক দেয়। হুড়মুড়িয়ে উঠে দেখি তিনি সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার কান্নার আওয়াজে প্রতিবেশিরা আসে তাকে দেখতে। সবার চোখেই পানি। মেয়েকে ঘুম থেকে তুলে আদর করতে করতে বলতে লাগলেন, মা গো আমরা স্বাধীন হইছি। তার সেই আনন্দাশ্রু মিশ্রিত কথাটি আমার কানে এখনো ভেসে ওঠে।’
ফুলতারার বাড়ি মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার ধানকোড়া ইউনিয়নের নয়াডিঙ্গী গ্রামে। চার মেয়ে আর এক ছেলে। ছেলে মেয়েদের বিয়ে সাদি হয়ে সংসার পেতেছে। সবারই সুখের সংসার। তাদের ঘরে সাত নাতি- দুই নাতিন। তারাও পড়াশোনা করে, চাকুরী করে স্ব স্ব স্থানে প্রতিষ্ঠিত। বড় মেয়ে রিজিয়া বেগমের বাড়ি ঘিওরের রাথুরা গ্রামে, মেঝ মেয়ে ফাতেমার বাড়ি বানিয়াজুরীতে। তিনি বানিয়াজুরী সরকারি স্কুল এন্ড কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সদস্য। সেঝ মেয়ের বিয়ে হয়েছে ঘিওরের রাধাকান্তপুর গ্রামে, ছোট মেয়ে রুকসানা আক্তার রুবির শশুর বাড়ি ঢাকায়। পেশায় সে সরকারি হাসপাতালের সেবিকা আর একমাত্র ছেলে শাহজাহান পেশায় বেসরকারী চাকুরিজীবী।
ফুলতারার ছেলে মো. শাহজাহান বলেন, ‘আমার পিতা বীরমুক্তিযোদ্ধা মৃত বছির উদ্দিনের মুক্তি বার্তা নং-০১০৭০৫০১২০, গেজেট নং-১৮৪২। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সনদ নম্বর-২০৭৪১। বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে আমার বাবা দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হিসেবে এটাই আমাদের অনন্য গর্ব।’
শেষ বয়সে মুক্তিযোদ্ধা বছির উদ্দিন দীর্ঘদিন রোগে ভুগে ২০০৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি মারা যান। স্বামীহারা ফুলতারা জীবনের অনেক কিছু পেয়েছেন অনেক কিছু বিসর্জন দিয়েছেন, পালিয়ে বেড়িয়েছেন দীর্ঘ সময়। খেয়ে না খেয়ে দিন পাড় করেছেন। কিন্তু তারপরেও তার এক ফোটা কষ্ট নেই। কারণ তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী। এটা ভাবতেই গর্বে তাঁর বুক ভরে উঠে।’