পদ্মাপারের প্রান্তিক মানুষের বন্ধু বাবু হরিপদ সূত্রধর
মানিকগঞ্জ থেকে মো: নজরুল ইসলাম
‘মানুষ মানুষের জন্য, মানুষ তার জীবনের জন্য এবং প্রকৃতি পরিবেশের জন্য। যে প্রকৃতি আমাকে বিনামূল্যে আলো, বাতাস ও বায়ু দিয়ে বড় করেছে, আমি তার কাছে ঋণি, যে সমাজ আমাকে সভ্যতা, সামাজিকতা শিখিয়েছে আদর যত্নে লালন করেছে তার কাছেও কম ঋণী নই, আমার জীবন শুধু একটি পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, আমি সকলের মাঝে বাচঁতে চাই’- এমন কথা বর্তমাান সমাজে কজনাই বলতে পারে লালন করতে পারে। সাহস করে যিনি হরহামেশাই এসব কথা শুনিয়ে থাকেন তিনি হলেন হরিপদ সূত্রধর।
বাবু হরিপদ সূত্রধর মানিকগঞ্জ হরিরামপুর উপজেলাধীন রামকৃষ্ণপুর গ্রামে ১৯৪৬ সালের ২২ অগ্রহায়ণ মাসে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর স্ত্রীর নাম রেনুবালা সূত্রধর, তার দুই ছেলে কর্মজীবী, একমাত্র মেয়ে বিবাহিত। তিনি ১৯৬১ সালে ম্যট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৬৫ সালে সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট পাশ করেন। ১৯৬২ সালে রামকৃষ্ণপুর জুনিয়র হাইস্কুল থেকেই প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব নিয়ে শুরু করেন কর্মজীবন। তারপর ১৯৬৮ সালে পাবনা জেলার বেরা উপজেলাধীন ধোবাখোলা করোনেশন হাই স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। তারপর ১৯৭০ সালে পাটগ্রাম অনাথবন্ধু সরকারি হাই স্কুল শুরু করেন শিক্ষকতা এবং অবসরে আসেন এই বিদ্যালয় থেকেই ২০০৩ সালে।
ছাত্র জীবনে সমাজতান্ত্রিক চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির মাধ্যমে কমিউনিষ্ট আন্দোলনে নিজেকে নিবেদন করেন। ক্ষেতমজুর আন্দোলন করতে গিয়ে কারাবরণ করতে হয়েছে কয়েক দফা। বর্তমানে তিনি হরিরামপুর উপজেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি ও জেলা কমিটির সম্মানিত সদস্যের দায়িত্ব পালন করছেন। সংসার এর ঘানী সামলিয়ে কর্মজীবনের দায়িত্ব পালন করেও সময় দিয়েছে সমাজ পরিবর্তনের কাজে। একদিকে মাঠের আন্দোলনেও যেমন সক্রিয় তেমনি ছিলেন তার ক্ষরধার লেখনির দিয়ে। তিনি যাত্রার দলের অভিনেতা ছিলেন, গান ও নাটকও করতেন মনের মাধুরী মিশিয়ে। তিনি অর্ধশতাব্দী যাবৎ হরিরামপুর পদ্মাভাঙ্গন অবহেলিত পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য আলো ছড়িয়ে আসছেন নানা দিক থেকে। উল্লেখ্য যে, তিনি শিক্ষা সংস্কৃতির আলো ছড়িয়েছেন, প্রগতি ও মুক্তির গান, অভাবনীয় প্রতিকূলতার মধ্যেও আপষহীনভাবে চালিয়ে গেছেন তার সংগ্রাম। অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার সংগ্রাম, ভাষা ও দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার সংগ্রাম, আলোকিত মানুষ গড়ার সংগ্রামে এখনো নিবেদিত রেখেছে নিজেকে।
কমরেড হরিপদ সূত্রধরকে তার আলোকিত শিক্ষার্থীরা মনে রেখেছে হৃদয়ের মণিকোঠায়। তাই তো অখ্যাত এই মানুষটিকে গত ১৯ নভেম্বর ২০১৯ ‘বটতলা রঙ্গমঞ্চ’ নামক একটি সাহিত্য সংগঠন নাটকে বিশেষ অবদান রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে সম্মাননা প্রদান করেন। এই সংগঠন প্রতিবছর প্রত্যেক বিভাগ থেকে একজন করে নির্বাচন করেন ঢাকা বিভাগ থেকে মানিকগঞ্জ হরিরামপুর থেকে তিনি নির্বাচিত হন। বটতলা রঙ্গমঞ্চ বিচার করে তাকে অভিহিত করেছেন এবং তারা তাকে মনে করেন বিশিষ্ট নাট্যকার, নাট্য সংগঠক, সংস্কৃতি সাধক, বিপ্লবী নেতা, নিভৃতিচারি দার্শনিক বাবু হরিপদ সূত্রধর। তাকে এই বিরল সম্মান দিয়ে মানিকগঞ্জবাসীকে আরো গর্বিত করেছে এবং আদর্শিক রাজনীতির সূতিকাগার কমিউনিষ্ট আন্দোলনকে আরো বেগবান করেছে বলে আমরা মনে করি।
কথায় আছে, যে দেশে জ্ঞানী লোকের কদর হয় না সে দেশে জ্ঞানী লোকের জন্ম হয় না। এ দেশে প্রগতিমূখীন সংগঠনগুলো ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করতে না পারলেও অসংখ্য হরিপদ সূত্রধরকে সৃষ্টি করেছে মন্থরগতিতে হলেও এখনো করছেন। তাই এই প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচর্যা করেই সমাজ পরিবর্তন করতে হবে। হরিপদ সুত্রধর বলেন, ‘খেলাঘর ছাত্র ইউনিয়ন না করলে আমি এত কিছু করতে পারতাম না, এই রাজনৈতিক চর্চা আমাকে গরিব করে নাই, জ্ঞনে গুনে ধনী করেছে। জীবনে অর্থবিত্ত ত্যাগ করেছি কিন্তু মানুষের ভালোবাসা অনেক পেয়েছি এটাই আমার বড় পুঁিজ।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি হতাশ নই এখনো স্বপ্ন দেখি সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার সাধ্যমত সমাজ প্রগতির লড়াইকে তরান্বিত করার জন্য কাজ করছি। যতদিন আছি অন্যয় অবিচার এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই অব্যাহত রাখব।’