করোনার কালে কয়েকটি কথা
ঢাকা থেকে তান্ইয়া নাহার
কী অদ্ভুত একটি ক্রান্তিকাল পার করছি আমরা! একটি ভাইরাস, একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অণুজীবের কাছে দিন কে দিন জিম্মি হয়ে পড়ছে প্রায় গোটা বিশ্ব। সমাজবদ্ধ জীব হিসেবে আত্মপরিচিতিদানকারী মানবজাতিকে আজকে বাধ্য হয়ে এড়াতে হচ্ছে পরস্পরের সঙ্গ। ক্রমশঃ কী দুঃসহ হয়ে উঠছে এ নিরাময়হীন অসুখের ভয়, সম্ভাব্য মৃত্যুর আশঙ্কা আর প্রতি মুহূর্তে অপ্রতিরোধ্যভাবে ভাইরাসটির রোগ বিস্তার প্রবণতার ভয়ঙ্কর সব খবর। গত চার/পাঁচ মাস ধরে সারা পৃথিবীর মনোযোগ ধরে আছে এই করোনা ভাইরাস এবং ভাইরাসটির কারণে সৃষ্ট কোভিড-১৯ নামক দুরারোগ্য অসুখটি। দেশ-সীমানা পেরিয়ে অতি সহজেই ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়ছে বৈশ্বিক মানচিত্র জুড়ে। কিছুতেই যেন সে আর বাঁধ মানছে না। যেনবা সে মানব সভ্যতাকে এবং মানুষের এ যাবতকালের ধ্যান ধারণাকে কঠিন এবং অকল্পনীয় কোন ধাক্কা দেয়ার ব্রত নিয়েই এগোচ্ছে! কোন স্থান-কাল-পরিবেশ-আবহাওয়া-ব্যক্তিভেদ কোন কিছুই সে মানছে না! এমনই সাম্যবাদী এই ভাইরাস ও এর কারণে সৃষ্ট এ রোগটি!
এতদিনে আমরা প্রায় সবাই করোনা ভাইরাস এবং কোভিড-১৯ সম্পর্কে ধারণা নিয়ে ফেলেছি। উন্নত দেশগুলো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে রোগ প্রতিরোধমূলক ওষুধ বা সহজে নিরাময়লাভের চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কারের। চেষ্টা থেমে নেই আমাদের মত স্বল্পন্নোত দেশেরও বেঁচে থাকার পথ বের করার। সরকারের শুরুর দিকের গাফিলতি সমালোচনার দাবী রাখে যদিও, তবে জনগণ হিসেবে আমাদেরও দায়িত্ব-কর্তব্য কিছু কম নেই এই বিশেষ পরিস্থিতিতে। কিন্তু ভাইরাস এবং এর রোগের ধরণটি এমন যে চাইলেই আমরা তা নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি ভূমিকা রাখতে মাঠে নামতে পারবো না। আর তাই আমাদের দায়িত্ব-কর্তব্যের মধ্যে সবার আগে যেটি পড়ে তা হল, সম্পূর্ণভাবে ঘরে থাকা। ঘরে থেকে ঘর ও ঘরের মানুষজনদের সাথে নিজেকে শারীরিক-মানসিকভাবে সুস্থ-স্বাভাবিক রাখাই বর্তমানে আমাদের ব্যক্তিগত বিপ্লব বলেন, যুদ্ধ বলেন বা ইবাদত-উপাসনা বা ধ্যান-জ্ঞান বলেন সব। এতেই আমরা পারি মানবজাতি হিসেবে, দেশের নাগরিক হিসেবে সর্বোপরি একজন সচেতন মানুষ হিসেবে নিজের কর্তব্যটুকু করে চলমান সংকটে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে। নিজে কোনভাবে ভাইরাসের বাহক না হয়ে তা আর কারও মাঝে ছড়িয়ে দেবনা এই শপথই এখন সবচে’ বড় শপথ।
তবে সত্যি এটাই যে, মানুষ একটি গৃহকাতর প্রাণী হলেও গৃহবন্দিত্ব আবার তার কাম্য নয় মোটে। মানুষের তাই ঘরও লাগে, বাহিরও লাগে নানা প্রয়োজনে। আর দিনের পর দিন ঘরে থাকার বাধ্যবাধকতায় মানুষ হয়ে পড়ছে অসহিষ্ণু, রোগ নিয়ে ভয় বাদেও অদ্ভুত সব অস্থিরতায় মানুষকে তাই দিনাতিপাত করতে হচ্ছে। আর এতে করে বাড়ছে মানুষের মানসিক সমস্যা, পারিবারিক সহিংসতা, কলহ-বিবাদ এবং অপরাধপ্রবণতা। এমনটি চলতে থাকলে প্রশাসনের লোকজনকে অচিরেই আবার ব্যস্ত হয়ে যেতে হবে কোভিড-১৯ বিস্তাররোধে বেপরোয়া মানুষজনদের ঘরে ঢোকানোর দায়িত্ব নেয়ার সাথে ঘরে ঘরে সৃষ্ট অপরাধ দমনের বাড়তি তৎপরতা বাড়ানোতে। সেটা কি এই মুহূর্তে প্রয়োজনের অতিরিক্ত কাজ হয়ে দাঁড়াবে না? আর তাই আমরা যারা নিজেদেরকে সভ্য, শিক্ষিত, আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, যৌক্তিক, মানবিক এবং পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রাপ্ত বলে মনে করি, বিশ্বাস করি বা দাবীও করি তাদের এখন উচিত হবে ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও নিজ নিজ কর্তব্যটুকু পালন করে যাওয়া। যেখানে ডাক্তার-পুলিশ-ব্যাংকার-বিচারকদের মত পেশাজীবীদের এত এত ভয়াবহ সময়েও পেশাগত দায়িত্বপালনে পিছপা হওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে আমরা যারা সুযোগ পাচ্ছি তারা যেন তা যথাযথভাবে কাজে লাগাই।
আমরা অযথা বাইরে না যাই, বাইরে গিয়ে পুলিশের সাথে লুকোচুরি না খেলি, ব্যাংকে রোজদিন অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভিড় না করি, ছোটখাট অসুখবিসুখ ঘরে থেকেই যথাসম্ভব সারিয়ে তোলার চেষ্টা করি, সর্পোপরি আইন অমান্য করার বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চোখকে ফাঁকি দেয়ার মূর্খ প্রচেষ্টা থেকে যেন নিজ দায়িত্বে বিরত থাকি। এরপরও আরও কিছু দায়িত্ব থেকে যায়। সেগুলোও ঝুঁকি গ্রহণ করে সেবাদানকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থাগুলো থেকে নিতান্ত মামুলি। যেমন- আমরা নিজ নিজ ঘরকে যেন অন্তত সুরক্ষিত রাখার ব্রত নিই। সারাক্ষণ রোগ নিয়ে দুশ্চিন্তা করে ও তা না ছড়িয়ে ঘরের মানুষদের সাথে কাজ ভাগাভাগি করে, গল্প করে, কৌতুক করে, ইবাদত-বন্দেগী, ধ্যান- যার যেটা ভালো লাগে সেটা করি। ছোটখাট বিষয়ে পরস্পরকে দোষারোপ না করে এখন থেকেই ছাড় দিতে শিখি। কারণ সামনের অনিশ্চয়তার দিনগুলোতে বাইরের পৃথিবীতে বের হওয়ার সুযোগ হলেও কত কত ছাড় যে বাধ্য হয়ে দিতে হবে তার কোন ইয়ত্তা নেই। মানুষের অসুখে পৃথিবী সুস্থ হয়ে উঠছে, এই খবরগুলোকে গুরুত্বসহকরে নিতে শুরু করি যেন এখন থেকেই। নিজেদের বদভ্যাসগুলোকে ত্যাগ করতে শিখি যেগুলো পৃথিবীর পরিবেশ, প্রতিবেশ, আবহাওয়া ও জলবায়ুর জন্য ক্ষতিকর। সামনের দিনগুলোর অর্থনৈতিক ধাক্কা সামলাতে পরিবারের সবাই মিলে প্রস্তুত থাকার চেষ্টা করি। ব্যয় কমাই, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনি, বিকল্প খাদ্য পরিকল্পনা করি, বিলাসিতা স্থায়ীভাবে কমানোর মানসিকতা গড়ি। অতিরিক্ত সবকিছুকে না বলি, অতি খাওয়া, অতি পরিধান, অতি পণ্যমজুদ, অতি সমালোচনা, অতি রাগ, অতি আলসেমি, অতি পরনির্ভরশীলতা এ সবকিছুকে না বলি। পরিবারের ছোটদের মধ্যে স্থায়ীভাবে এ চিন্তা ও মানসিকতা গড়ে তুলি। ধর্মের নামে, আল্লাহ-ভগবানের নামে, রাজনীতি ও ক্ষমতানীতির নামে মিথ্যাচার ও গোঁয়াতুর্মি থেকে বের হয়ে এসে মানুষের জন্য ভালো চিন্তা করি।
সম্ভব হলে যার যার সাধ্যমত অভাবী-নিরন্ন মানুষের জন্য দূর থেকেই সাহায্যের হাত বাড়াই। পরিবারের শিশু, বয়োঃবৃদ্ধ ও রোগীদের বিশেষ যত্ন নিই। চলমান অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে, অন্যায়কারীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে কাছের মানুষদের উপর রাগ না ঝাড়ি। ইতিবাচক চিন্তা জারি রাখি, হাজারও অমঙ্গল আশঙ্কা সত্ত্বেও বাঁচার আশা নিজে না হারাই, প্রিয়জনদেরও হারাতে না দিই। বিপদে সহযোগিতার আশ্বাস ও ভবিষ্যতের সব চ্যালেঞ্জ মিলেমিশে মোকাবেলার আশা দিয়ে আমরা যেন এখন শরীরিকভাবে পাশে না থেকেও মানসিকভাবে প্রিয়জন, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধব, পরিচিত-পরিজনদের পাশে থাকি। মানুষ হিসেবে মানবিক হওয়ার এই তো সময়। আর কে না জানে মানুষ একটি অনন্ত সম্ভাবনাময় প্রাণী। সচেতন থাকি, নিয়ম মানি, আশা ধরে রাখি এক সুন্দর আগামীর। অপূরণীয় ক্ষতি হবে জেনেও হাল যেন আমরা কিছুতেই না ছাড়ি। জয় হোক সকলের।