বৈচিত্র্যময় ফসল আবাদের মাধ্যমে কৃষকরা দুর্যোগ মোকাবেলা করেন
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ সত্যরঞ্জন সাহা: করোনার কারণে আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য দিবস ঘটা করে উদযাপন করতে না পারলেও কৃষকরা বৈচিত্র্য ও খাদ্য নিরাপত্তায় কাজ করছেন। আমরা সকলে করোনা মোকাবেলায় এক ধরনের যুদ্ধ করছি। করোনাকে জয় করতে কৃষকগণ মাঠে অবিরাম কাজ করছেন। পরিবারের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে দেশের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। তারা তাদের বসতবাড়ির আনাচে কানাচে কোথাও শাক-সবজি, আবার কোথাও ফলের গাছ রোপণ করছেন।
গ্রামে ফলমূল পাকতে শুরু করেছে। এই মধু মাসে দেশীয় ফলের কমতি নেই। আদর আপ্যায়নেও গ্রামের মানুষের জুড়ি নেই। তারা পড়শী বা আত্মীয়কে বসতে দেন পিড়িতে, খেতে দেন গাছের ফল, সাথে বাড়ির ভাজা মুড়ি, সেয়াই, পিঠা-পায়েশ ইত্যাদি। পাড়া প্রতিবেশীগণ খবর নেন আত্মীয় পরিজনের, সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন! প্রকৃতির মাঝে হৃদয় বন্ধন তৈরি হয় আবাদ বৈচিত্র্যের বীজ ও তথ্য বিনিময়ের মাধ্যমে। কৃষকগণ প্রাণ, প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে নিজে স্বনির্ভরতা অর্জন করেন। এতে করে বাঁচে সকল প্রাণবৈত্র্যি, সহায়ক হয় একে অপরের। তবে করোনার কারণে গ্রামের মানুষের মধ্যে সামাজিক দূরুত্ব সৃষ্টি হয়েছে। করোনা মোকাবেলায় সম্পর্ক ছেদ হয়েছে, বেড়েছে সামাজিক দূরত্ব।
ঘরিরামপুরের হরিহরদিয়ার নারী রেজিয়া বেগম (৫৫) বলেন, ‘মহামারী করোনায় আমাদের পড়শীর মাঝে দূরুত্ব সৃষ্টি করছে। আমরা গ্রামের মানুষ একে অপরের সহযোগিতায় প্রাণ, প্রকৃতিকে সাথে নিয়ে বেঁচে থাকি। নারীগণ বাড়িতে পতিত জায়গায় মসলা, শাক-সবজি চাষ করে খাদ্য চাহিদা পূরণ করেন। পরিবারে গরু-ছাগল, ছাগল-ভেড়া, হাঁস-মুরগি, কবুতর পালন করে অর্থনৈতিকভাবে সহায়ক হয়। প্রাণবৈচিত্র্য ব্যবহারে আমরা ভালোভাবে ও সহজে টিকে আছি। গ্রামের মানুষের ভেষজ উপায়ে চিকিৎসা ও নিরাময়ে প্রাণবৈচিত্র্য ব্যবহার ও সংরক্ষণ করছেন।’ তিনি আরও বলেন, ‘কৃষি ক্ষেত্রে নারীদের বীজ সংরক্ষণ ও ফসল ঘরে তোলা, প্রাণি সম্পদ পালন ও ঘর গোছালীর কাজে অত্যন্ত আন্তরিক। কৃষি কাজে নারীও পুরুষের পাশাপাশি গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গ্রামের মানুষ প্রাণবৈচিত্র্য বিস্তার ও সংরক্ষণে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। জৈব কৃষি চর্চা, কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য উদ্ভিদের ব্যবহার ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক হয়। কৃষাণীদের মধ্যে বীজ বৈচিত্র্য বিনিময়ের মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্য বিস্তার ঘটে, আবাদে বৈচিত্র্যতা আনে।’
অন্যদিকে বরুন্ডির কৃষক বৈদ্যনাথ সরকার (৬৫) বলেন, ‘গ্রামে জৈব কৃষি চর্চায় প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা হয়। প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, ঝড়, খরা) মোকাবেলায় সহায়ক হয়। প্রাণ-প্রকৃতি সংরক্ষণে জৈব উপায়ে আবাদ, বীজ বৈচিত্র্য সংগ্রহ ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ স্থানীয় সম্পদের বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘কবিরাজগণ ভেষজ ঔষধে ব্যবহারের জন্য বাড়ির পালানে ঔষধি গাছ সংরক্ষণ করেন। তাঁরা হাতিরশুর, নিশিন্দা, উলট কমল, হাড ভাঙ্গা, ঘৃতকমল, দন্ডকলস, শিমুল মূল, অগ্নিশ্বর, আকন্দ, নিম, অর্জুন, সাদা ধুতরা, কালো দুতরা, কাটা কচু, সাদা লজ্জাপ্রতি, লাল লজ্জাপ্রতি, কল্পনাথ, পাথরচুনা, টাকা থারকুন, রাম তুলসি, কাল তুলসি, সাদা তুলসি, ডাইবেটিস গাছ, আলোকলতা, বাশক, ঘাপাতা, দুধরাজ, লালপাতা, তেলাকুচা, আতিরশুর, কালো কেসরী, নলটুনি, ফটকা, কাটাগুর, বাউয়লতা, ইত্যাদি সংরক্ষণ করেন। গ্রামের মানুষ ও প্রাণি সম্পদের প্রাথমিক ভেষজ চিকিৎসায় ঔষধ ব্যবহার করে জীবন রক্ষায় সহায়ক হয়। এতে করে সহজে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা হয়।’
স্থায়িত্বশীল কৃষি আবাদের মধ্য দিয়েই বৈচিত্র্য রক্ষা পায় ও খাদ্যের ভিন্ন ধরনের স্বাদ, রস, গুণ ও মান ঠিক থাকে। কৃষকগণ রকমারি ফসল আবাদের মাধ্যমে দুর্যোগ মোকাবেলা করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় ফসল বৈচিত্র্যকে টিকিয়ে রাখতে অভিজ্ঞতা, বীজ বিনিময় ও তথ্য আদান-প্রদানে সহায়তা করে আসছেন। মিশ্র ফসল চাষাবাদে প্রাণবৈচিত্র্য ও মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় ও কৃষি বৈচিত্র্যতা রক্ষা হয়।