কৃষকদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে মিশ্র ফসল চাষ
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
বাংলাদেশ বর্তমানে সারা বিশ্বের নিকট উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে পরিচিত। এদেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীই কৃষির উপর নির্ভরশীল। বর্তমান সময়ে কৃষি পেশার সাথে এদেশের বেকার ও শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর যুক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। সামর্থ অনুযায়ী কেউ ফিসারী, গবাদি পশু ও পাখির খামার, বৈচিত্র্যময় ফল, সবজি ও ফুল উৎপাদন করে বেশ লাভবান হচ্ছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়নে কৃষকরা বিভিন্ন আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ও উপকরণ ব্যবহার করছেন। মাছ চাষ, ফল, ফুল, সবজি ও গবাদি পশু চাষে অনেকে মিশ্র চাষ পদ্ধতি অনুসরণ করে বেশ লাভবান হচ্ছেন। আজ আমি মিশ্র ফসল চাষ নিয়ে সামান্য আলোকপাত করার সাহস দেখাচ্ছি। গ্রামাঞ্চলের কৃষকরা ফসল চাষে কয়েক ধরণের পদ্ধতি অনুসরণ করে, যেমন- একক ফসল চাষ, সাথী ফসল চাষ ও মিশ্র ফসল চাষ পদ্ধতি। এই পদ্ধতিগুলোর একেকটির একক ধরণের উপকারীতা ও গুরুত্ব রয়েছে। আজ আমি মিশ্র ফসল চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করছি।
মিশ্র ফসল চাষ কি
সাধারণত মূল ফসলের সাথে স্বল্প মেয়াদের একাধিক ফসল চাষ করার পদ্ধতিকে মিশ্র ফসল চাষ পদ্ধতি বলা হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মূল ফসলের সাথে যেসব একাধিক ফসল চাষ করা হয় সেগুলোর জীবনকাল মূল ফসলের চেয়ে কম হয় এবং এগুলো চাষের ফলে মূল ফসলে কোন ক্ষতি হয় না। বরং এর ফলে মূল ফসল বিভিন্ন পোকামাকড় বা ক্ষতিগ্রস্ত প্রাণী দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া থেকে রক্ষা পায়।
মিশ্র ফসল চাষের উপকারিতা
মিশ্র ফসল স্বল্প মেয়াদী হওয়ায় মূল ফসলের আগে সংগ্রহ করা যায় এবং উৎপাদন খরচ খুবই সাশ্রয়ী (খরচে নেই বললেই চলে)। মূল ফসল চাষের খরচ দিয়েই এটি চাষ করা যায়। মিশ্র ফসল চাষ করলে মূল ফসল উঠার অপেক্ষায় কৃষককে বসে থাকতে হয়না। মূল ফসলের আগেই মিশ্র ফসল তুলে/বিক্রি করে মূল ফসল চাষের আর্থিক সংকট লাঘব করা যায়। ফলে কৃষকদেরকে ফসল উৎপাদনে কোন সম্পদের ক্ষতি করতে/ঋণ করতে হয়না। মিশ্র ফসল চাষ করলে ফসলের বিভিন্ন রোগবালাই ও ক্ষতিকর প্রাণীকুল থেকে মূল ফসল রক্ষা পায়। মিশ্র ফসল চাষে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি পায় এবং ভালো ফলন পাওয়া যায়। মিশ্র ফসল চাষের ফলে জমিতে পাখিসহ প্রাণবৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায়। ফলে চাষকৃত ফসলে ক্ষতিকর রোগবালাইয়ের আক্রমণ যেমন কম হয় তেমনি ফলনও ভালো হয়। মিশ্র ফসল চাষের ফলে একই সাথে বৈচিত্র্যময় খাদ্য উৎপাদন করা যায় এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্য সহজলভ্য হয়।
সাধারণত পাহাড়ী এলাকা ও চর এলাকায় মিশ্র ফসল চাষ লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকা (রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি), মধুপুর গড়াঞ্চল এবং নদীর চর এলাকার কৃষকরা মিশ্র ফসলের চাষ করে থাকে। এছাড়াও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকরাও কম বেশি মিশ্র ফসল চাষ করে। বাংলাদেশের কৃষকরা সাধারণত যেসব ফসলের সাথে মিশ্র ফসল চাষ করে থাকে সেগুলো হল- ইক্ষুর সাথে (আখ) খেসারী/মসুর/ছোলা, চালকুমড়া/লাউ/করলা/পটল ইত্যাদির সাথে লালশাক/ডাটা/পালংশাক/মূলা শাক, ফুলকপি/বাঁধা কপির সাথে পিয়াজ/রসুন/লালশাক/ডাটাশাক, বোনা আউশ ধানের সাথে ভাঙ্গি/খিরা/ফ্রুটি/ভূট্টা/দেউধান, আনারসের সাথে পেঁপে/কলা/আদা/কচু/হলুদ/মরিচ/লেবু, লেবুর সাথে পেঁপে/চীনকচু/মরিচ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
আজ আমি মধুপুর গড়াঞ্চলের কৃষকদের বাণিজ্যিকভাবে মিশ্র ফসল চাষ পদ্ধতি নিয়ে কিছু আলোচনা করার চেষ্টা করছি। মধুপুর গড়রাঞ্চল আজ থেকে ১৫ বছর আগেও শুধুমাত্র আনারস, আদা ও কচু চাষের জন্য দেশব্যাপী পরিচিত ছিল। মূলত মধুপর গড়ের জমি এবং বনের (ফরেস্ট্রি) জমিতে এসব ফসল চাষ হয়ে থাকে। ১৯৮৯ সাল থেকে মধুপুরে বনবিভাগ এগ্রোফরেস্ট্রি প্রাকৃতিক শাল বনে এগ্রোফরেস্ট্রি (কৃষি বন বাগান) ও উডলট ফরেস্ট্রির নামে বিদেশী আগ্রাসী প্রজাতির বাগান করে। এগ্রোফরেস্ট্রি ও উডলট ফরেস্ট্রি প্রকল্পে গাছের চারা রোপণের পর খালি জমিতে কয়েক বছর (৪/৫ বছর) সময় পর্যন্ত অন্যান্য কৃষি ফসল চাষ করা যায়। এই প্রকল্পের অধীনে সংশ্লিষ্ট এলাকার দরিদ্র পরিবারগুলোকে বাগানের অংশিদার করা হয়। অংশীদাররা বরাদ্দ পাওয়া জমিতে রোপণকৃত গাছের চারা ১০ বছর পর্যন্ত তদারকি করে এবং দশ বছর হলে গাছগুলো অকশনে/নিলামে বিক্রি করা হলে নিলামকৃত টাকা বনবিভাগ ও অংশিদারের মধ্যে ৬০/৪০ % হারে বন্টিন হবে। গাছ বড় না হওয়া পর্যন্ত কৃষকরা জমিতে গাছের কোন ক্ষতি না হবেনা এমন যে কোন ধরণের ফসল চাষ করে ভোগ করতে পারে। পূর্বে এসব জমিতে একক ফসল হিসেবে শুধুমাত্র আনারস, আদা বা পঞ্চমূখী কচু চাষ হত। কিন্তু আধুনিক কৃষি ও প্রযুক্তির সুবাদে এবং মূনাফার আশায় কৃষকরা একই জমিতে মিশ্র পদ্ধতিতে একই সাথে ৪/৫ ধরণের ফসল চাষ করছে।
মধুপুর গড়ে ফসল চাষ পদ্ধতি সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায় উডলট বাগানে গাছের চারার ফাঁকে ফাঁকে সারি করে আনারস চাষ করা হয়েছে। আনারসের সারির ফাঁকে ফাঁকে আবার মিশ্র ফসল হিসেবে আদা, পেঁপে, কলা ও মরিচের চাষ করা হয়েছে। আবার উডলট বাগান ছাড়া কৃষকদের নিজস্ব জমিতে মূল ফসল আনারসের সাথে পেঁপে, আদা, কচু, কলা, লেবু চাষ করা হয়েছে। এ বিষয়ে কৃষক ফারুক আহম্মদ বলেন, ‘আগে আমরা জমিতে শুধুমাত্র একক ফসল আনারস/আদা/কচু চাষ করতাম। কিন্তু ২০২০ সালের দিকে মধুপুরে নেপালী কলার চাষ আরম্ভ হয়, পাশাপাশি পেঁপে চাষ শুরু হয়। কিন্তু একক ফসল চাষ করে বেশিরভাগ সময়ই আমরা ভালো বাজারমূল্য না পাওয়ায় আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই। তারপর থেকে কৃষি বিভাগ, বিভিন্ন এনজিওদের পরামর্শে (যেমন-প্রশিকা) আমরা মিশ্র ফসল বা আন্তঃফসল পদ্ধতিতে চাষ আরম্ভ করি। এতে একটি ফসলে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অন্যান্য ফসলের মাধ্যমে লাভবান হচ্ছি। এছাড়াও মিশ্র ফসল চাষ করতে আমাদের বীজ বা চারা ক্রয় এবং রোপণ ছাড়া সার বা পরিচর্যা বাবদ তেমন কোন খরচ হয়না। মূল ফসল আনারসের পরিচর্যার খরচ দিয়েই মিশ্র ফসল চাষ করে ঘরে তোলা যায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমি আনারসের সাথে পেঁপে, কলা, লেবু এবং নাগা (কামরাঙ্গা) ও উব্দা মরিচ চাষ করেছি। এছাড়াও অঅমার বসতভিটার প্রায় দশ শতাংশ জমিতে বৈচিত্র্যময় ফলের মিশ্র চাষ করেছি, যেমন- আ¤্রপালি আম, ফজলি আম, লে্ড়ংাসহ পাঁচ জাতের আম, আপেল কুল, বাউ কূল, কাশমিরি কূল, রামবুথান, ডুরিয়ান, অ্যাবাকাডো, ট্যাং ফল, চায়না থ্রি লিচু, বোমবাই লিচু, কাঁঠাল, ড্রাগন ফল, আঙ্গুর, নাশপাতি ইত্যাদি। মিশ্র ফসল চাষ করে আমি খুবই লাভবান। আনারসের ফলন আসতে কমপক্ষে ১৮ মাস সময় লাগে। কিন্তু মিশ্র ফসল চাষ করে আমি ৪/৬ মাসের মধ্যে পেঁপে, মরিচ এবং এক বছরের মধ্যে কলা, আদা, কচু ও লেবুর ফলন পাচ্ছি। মিশ্র ফসল বিক্রি করে আমি সংসারের অন্যান্য কাজ করতে পারছি এবং আনারস চাষের খরচ বহন করতে পারছি।’
তিনি বলেন, ‘এছাড়াও মিশ্র ফসল চাষ করে আমি বৈচিত্র্যময় ফলও খেতে পারছি। জমিতে এককভাবে শুধু আনারস চাষ করলে কাঠবিড়ালী, বানর, হনুমান, শিয়াল ও টিয়া পাখিসহ বিভিন্ন ধরণের ফল খেকো পাখি আনারস খেয়ে ক্ষতি করে। কিন্ত মিশ্র ফসল চাষ করায় এসব প্রাণী পেঁপে, কলা ও মরিচের দিকে নজর দেয়। বাগানে অনেক ধরণের খাবার থাকায় তারা একটি ফসলের উপর হামলে পড়েনা, ফলে এককভাবে কোন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়না। যেমন শিয়াল আনারস, বানর/হনুমান/পাখি কলা ও পেঁপে এবং টিয়া পাখি মরিচ খায়। অন্য দিকে আদা/হলুদ থাকায় বাগানে আগাছা জম্মাতে পারেনা, আদা/হলুদা গাছের পাতা জমিতে সারের কাজ করে। আদা/হলুদ কোদাল দিয়ে খুড়ে তুলতে হয় বলে আনারসের ক্ষেত কোপানো হয় যায়। মোট কথা একটি কাজের সাথে অনেকগুলো কাজ হয়ে যায়।’
কৃষক ফারুক আহম্মদের মত কৃষক দুঃখু মিয়া, কামরুল হাসান, রফিকুল ইসলাম, আমান আলী, লিলি মাংসাং ও মিশ্র ফসল চাষের উপকারিতা ও গুরুত্বের কথা তুলে ধরেন। আদিবাসী গারো কৃষকরা আনারসের সাথে আদা/হলদু, পেঁপে, মরিচ, কলার পাশাপাশি শিমূল আলু (কাসাবা) চাষ করে।
নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার কৃষকরা রবি মৌসুমে একক ফসল হিসেবে জমিতে শুধুমাত্র চাল কুমড়ার চাষ করতেন। চাল কুমড়া বাণিজ্যিকভাবে চাষে অধি লাভ হওয়ায় এ অঞ্চলে দিন দিন এর চাষ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাদের জমি নেই তারাও অন্যের জমি ৪/৫ মাসের জন্য লিজ নিয়ে তাতে মাঁচা করে চাল কুমড়া চাষ করছেন। এক্ষেত্রে মাঁচা তৈরির জন্য বাঁশ, জিআই তার, নাইলন সূতা ও লেবার খরচ বাবদ অনেক খরচ হয়। জমি ভালোভাবে চাষ করে সঠিক দূরত্বে গর্ত করে চালকুমড়া বীজ/চারা রোপণ করার পর কৃষকরা মাঁচা তৈরি করে দেয়। কুমড়ার লতা মাঁচায় উঠতে প্রায় দুই মাস সময় লাগে। এই দুই মাস সময় পুরো জমি ফাঁকা পড়ে থাকে। চাষের সমস্ত খরচ কৃষকরা নিজেদের ঘর থেকে বা ঋণ করে চালায়। ২০১৭ সালে কলমাকান্দা উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের বড়দল গ্রামের এক কৃষককে চালকুমড়ার লতা মাঁচায় না উঠা পর্যন্ত জমি পতিত ফেলে না রেখে লালশাক/ডাটাশাক/পালংশাক সাথি ফসল হিসেবে চাষের পরামর্শ দিলে তিনি তাতে লালশাক বীজ বুনে দেন। এক মাসের মধ্যে লালশাক ৪-৫ ইঞ্চি বড় হলে তিনি ৪০ শতাংশ জমি থেকে প্রায় ৮০০০ (আট হাজার) টাকার লালশাক বিক্রি করে। এজন্য বীজ কেনা বাবদ তার মাত্র ৩০০ টাকা খরচ হয়। লালশাক বিক্রির টাকায় তিনি বাঁশ, তার ও সূতা কিনে ৪০ শতাংশ জমিতে চালকুমড়ার জন্য মাঁচা তৈরি করে দেন। তার দেখাদেখি অন্যান্য কুমড়া চাষিরাও এখন কুমড়ার ফলন আসার আগের সময়টিতে সাথী ফসল হিসেবে শাক জাতীয় ফসল চাষ করছেন।
উপজেলা কৃষি বিভাগ, বারসিকসহ বিভিন্ন এনজিও এবং শিক্ষিত উদ্যোগী ব্যক্তিও আধুনিক কৃষি প্রযুক্তির দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে কৃষকরা মিশ্র ফসল বা আন্তঃফসল ও সাথী ফসল চাষ করে কম খরচে বা একই খরচে একাধিক ফসল চাষ করে লাভবান হচ্ছে। পাশাপাশি এ পদ্ধতিতে ফসল চাষ করে কৃষকরা শস্য বৈচিত্র্য ও খাদ্য বৈচিত্র্য বৃদ্ধিতে যেমন অবদান রাখছে তেমনি মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি ও প্রাণবৈচিত্র্য বৃদ্ধিতেও অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে। তাই মিশ্র ফসল চাষ পদ্ধতি এখন কৃষকদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।