পৌষ সংক্রান্তি: গ্রাম বাংলার কৃষিকে এগিয়ে নেওয়ার এক ঐতিহ্য
মানিকগঞ্জ থেকে বিমল রায়
পৌষ মাসের শেষ দিন সাকরাইন। সাকরাইন কথাটি শোনার সাথে সাথে চিতই পিঠা, সরা পিঠা, সাজের পিঠা, কলি পিঠা, ভাঁপা পিঠা, দড়ি পিঠা,ভিজানো পিঠা, পাটি সাপটাসহ আরো নানান ধরনের পিঠার নাম চলে আসে। এসব পিঠার নাম শুনলেই শীতের সকালে মা, দাদী, নানিদের হাতে তৈরি পিঠা খাওয়ার কথা স্মৃতিতে ফিরে আসে। আমি গ্রামে বড় হয়েছি। আমার মাকে পৌষ সংক্রান্তির সময় নানানভাবে ব্যস্ত হতে দেখেছি। সংক্রান্তির কয়েকদিন আগেই নতুন আমন ধান ঢেঁকিতে আতপ চাল তৈরি করা এবং সংক্রান্তি আগের দিন বিকেলে সেই আতপ চালকে আবার ঢেঁকিতে গুড়া তৈরি করা এবং রাতে কয়েক ধরনের পিঠা তৈরির আয়োজন করতেন তিনি। বর্তমানে আমার মায়ের বয়স ৮০ ছুইঁছুই। পৌষ সংক্রান্তি বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, নতুন আমন ধানের চাল গুঁড়ো দিয়ে পরেরদিন খুব ভোরে বাড়ির বিভিন্ন স্থানে গুঁড়াগুলো বাড়িয়ে দেওয়া হয় গোল গোল আকারে তামাক খাওয়ার কলিক্যা দিয়ে, আর চালের গুঁড়ো মাপার বেতের সেরে জল দিয়ে গুলিয়ে নেওয়া হয়। এই চালের গুঁড়োগুলো বাড়ির গৃহপালিত প্রাণি গরুকেও তার শরীরে ছাপ দেওয়া হয়। সকল পিঠা বানানো শেষে বিভিন্ন ধরনের কৃষি উপকরণ লাঙল, জোয়াল ছোট ছোট আকারে চালের গুড়ো দিয়ে তৈরি করে মাটির পাত্রে খড়,পাটকাঠি, জল দিয়ে কোন কিছু দিয়ে ঢেকে আগুনে গরম করে পরের দিন নদীতে বা জলাধারে ফেলে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমার শাশুরীকে দেখেছি এই ধরনের কাজ করতে এবং কৃষিতে যাতে মঙ্গল হয়, কোন ধরনের বিপদ আপদ না হয় তার জন্য সংক্রান্তি পালন করতেন।’
এই প্রসঙ্গে কথা হয় হরিরামপুরের আন্ধারমানিক গ্রামের সুনীল বিশ্বাসের সাথে। তিনি বলেন, ‘পৌষ মাস মলমাস আর শীতকালের সূর্য্য দেবতার তাপ ও আলোতে আমরা বেঁচে আছি। আমাদের পাশাপাশি গৃহপালিত প্রাণি গরু, ছাগল, কৃষি আবাদ সকলই টিকে থাকে। তাই সূর্য দেবতার সন্মানে বাড়ির উঠানের মধ্যবর্তী স্থানে চালের গুঁড়োগুলো পিঠা খাওয়া হয়। গরুকেও কলিকা দিয়ে শরীরে ছাপ মেরে পিঠা খাওয়ানোর পাশাপাশি লেজের চুল কেটে ছোট করে দেওয়া হয়। কাটা চুল ঘরে সংরক্ষণ করলে গরুর রোগ/অসুখ কম হয়।’
সিংগাইরের বায়রা গ্রামের বিউটি আক্তার বলেন, ‘আমার দাদীকে গরুর ঘরে চুলা তৈরি, সকালে গোছল করে গুড়, দুধ, চাল দিয়ে সিনি রান্না করতে এবং কলা পাতায় পাড়ার সকলকে খাওয়াতে দেখেছি। আমার মা এখনও আমাদের ফুপু, খালাদের দাওয়াত দিয়ে সাকরাইনের দিনে পিঠা তৈরি করে খাওয়ান।’
বট, পাকোর, পঞ্চবটি বিভিন্ন বড়বৃক্ষকে কেন্দ্র করে বুড়া বুড়ির মেলার প্রচলন গ্রাম পর্যায়ে ও কোন খোলা মাঠে প্রান্তে হয়ে আসছে। গ্রামীণ এইবুড়া বুড়ির মেলা একবেলা বা কয়েক ঘন্টার জন্য অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। নারী, পুরুষ, কিশোর কিশোরীদের অংশগ্রহণে মেলাটি সেতুবন্ধনে পরিণত হয়। মানিকগঞ্জের পারিল, সানাইল, বরুনাসহ উল্লেখযোগ্য স্থানে বুড়াবুড়ির মেলা, নিসিক্যান্দা পূজাসহ আরো আচার অনুষ্ঠানসমূহ হয়ে থাকে। পৌষ সংক্রান্তি স্থান, দেশকাল ভেদে ভিন্ন নামে প্রায় কাছাকাছি নিয়মে পালিত হয়। ঘুড়ি উড়ানো, বুড়া বুড়ির মেলা, কালি পূজো, নিসকান্দ্যা পূজো, পালাগানের আয়োজনসহ আরো নানানভাবে স্থানীয় বিশ্বাস বা তাদের আচার অনুযায়ী নতুন আমন ধানের রকমারি পিঠা বা মিষ্টান্ন তৈরির মধ্য দিয়ে উৎসব পালিত হয়। নাগরার দুই শতাধিক বছরের রক্ষাকালি পূজো পৌষ সংক্রান্তিতে হয়। নাগরার কালিমন্দিরের সাথে গাজী পীরের ঘর আছে। পৌষ সংক্রান্তি দিনেই গাজী পীরের নামে সিন্নি দেওয়ার রেওয়াজ চালু আছে শতবছর ধরে।
শহর কেন্দ্রিক বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন পিঠা উৎসব হিসেবে পৌষ সংক্রান্তি পালন করে তাদের মতো করে। কোন পেশাদার পিঠা বিক্রেতাকে দিয়ে পিঠা তৈরি করে অতিথিদের পরিবেশন করা হয়। পিঠা পরিবেশনের পাশাপাশি বাউল গান লালন সংগীতসহ আরো কিছু পরিবেশন করা হয়। সকল কিছুই এক ধরনের অতি আধুনিকতার ছোঁয়া থাকে। মা, দাদীর হাতে পিঠার পরশ তেমন পাওয়া যায় না। শহরের নানান ব্যস্ততা ও বাস্তবতায় এই ধরনের উৎসবই অনেক বেশি প্রাণবন্তকর হয়ে উঠে।