এগুলো নিয়ে আমরা ঘরে বসে থাকবোনা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
বাংলাদেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকুলীয় অঞ্চল হলো দুর্যোগ প্রবল এলাকা। সমুদ্রকূলবর্তী হওয়াতে প্রতিনিয়ত নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। এর সাথে যুক্ত হচ্ছে মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ একাকার হয়ে এখানকার জনজীবন বিপন্ন হতে বসেছে। প্রতিনিয়ত নানান ধরনের দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হচ্ছে। বর্তমান সময়ে কোন একটি দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে না উঠতে নতুন নামের কোন দুর্যোগ এসে হাজির হচ্ছে। আর এ দুর্যোগের সাথে পাল্লা দিয়ে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর শেষ কবে কিভাবে হবে তা কারো জানা নেই। নানান ধরনরে দুর্যোগে এলাকার সব মানুষ তাদের নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তবে সব ক্ষেত্রে আগে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায় এলাকার যুবদের।
বিগত সময়ে যতগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছে সেখানে যুবরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। প্রত্যেকটি দুর্যোগের আগে ও পরে আমাদের যুবরা বসে ছিলো না। দুর্যোগের আগে তারা নানান ধরনের প্রচারণা চালিয়েছে। রাতদিন ধরে মানুষ, গবাদি পশু-পাখি, আসবাবপত্র, ঝুকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়াসহ প্রশাসন, স্থানীয় সরকার ও জনগোষ্ঠীর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখে। এছাড়া ঘূর্ণিঝড় পরবর্তী সময়ে এলাকায় কোথায় কি সমস্যা হয়েছে, কিভাবে তা সমাধান করা যাবে তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায় তারা। কখন নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া, খাবার ব্যবস্থা করা, ঘরের চালের ও রাস্তার উপরের ডাল কেটে দেওয়া, কারো ঘর সংষ্কার করে দেওয়া, সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা, ভাঙন কবলিত স্থানে বাঁধ নির্মাণ করাসহ নানান ধরনের ভূমিকা রাখছে উপকূলীয় যুবরা।
প্রতিটি দেশের উন্নয়ন ও সফলতার পিছনে যুবরা যে কতটা ভূমিকা রাখে তা বলে শেষ করা যায় না। তেমনি দুর্যোগের সময় তাদের যে ভূমিকা তাও প্রশংসনীয়। বিগত সময়ে উপকূলীয় এলাকায় যে দুর্যোগ হয়েছে সেখানে যুবদের উপরোক্ত নানামূখী উদ্যোগগুলো জানা যায়। বারসিক দীর্ঘদিন ধরে উপকূলীয় এলাকার দুর্যোগ সম্পর্কে যুবদের সক্ষমতা তৈরির লক্ষ্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। বারসিক’র নানানমূখী কাজের মধ্য দিয়ে আগ্রহী ও উৎসাহিত এবং অনুপ্রাণীত হয়ে উপকূলীয় এলাকায় দুটি স্বেচ্ছাসেবক টিম সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি ও সিডিও ইয়থ টিম গড়ে উঠেছে। এ সংগঠন দু’টি উপকূলীয় এলাকায় মানুষের জন্য স্বেচ্ছাশ্রমের বিনিময়ে উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছে। সে কাজের ধারাবাহিকতায় বিভিন্ন দুর্যোগের সময় যুবরা নানান ধরনের সমস্যার সন্মূখীন হয়। সেখান থেকে তারা দুর্যোগ মোকাবেলায় সক্ষমতা বৃদ্ধি ও স্বাস্থ্যবিধির জন্য বারসিক’র নিকট উপকরণ সহায়তার দাবি জানান। সে লক্ষ্যে যুবদেরকে বারসিক’র ইয়ুথ লেড ক্যাপাসিটি বিল্ডিং এন্ড ক্যাম্পেইন অন জেন্ডার এন্ড রিজিলেন্স প্রকল্প থেকে উপকরণ সহায়তা করা হয়। উপকরণের মধ্যে ছিলো হ্যান্ডমাইক, ছাতা, কুঠার, হাত করাত, গামবুট জুতা, রেইনকোট, মোবাইল পাওয়ার ব্যাংক, ফাস্টএইড বক্স ও টর্চলাইট ইত্যাদি।
দুর্যোগের সক্ষমতা বৃদ্ধির উপকরণ সহায়তা পরবর্তী যুব টিমের প্রনিনিধিদের কাছে এ উপকরণ কি কি কাজে লাগবে? কি উপকার হবে? এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সিডিও ইয়ুথ টিমের সভাপতি ওসমান গনি সোহাগ বলেন, ‘বারসিক উপকূলীয় এলাকায় যুবদেরকে সবসময় অনুপ্রেরণা ঝুগিয়েছে। তাদের অনুপ্রেরণায় আমাদের এত দুরে আসা। আমরা দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় বাস করি। দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য উপরোক্ত উপকরণগুলো খুবই জরুরি কিন্তু আমাদের মতো যুবদের পক্ষে এসব উপকরণ ক্রয় করা কঠিন ছিলো। তাই আমরা বারসিক’র নিকট থেকে পেয়েছি। আমরা হ্যান্ডমাইক-১২টি, ছাতা-৯৭টি, কুঠার-১২টি, হাত করাত-৬টি, গামবুট জুতা-৬০ জোড়া, রেইনকোট-৬০টি, মোবাইল পাওয়ার ব্যাংক-১২টি, ফাস্টএইড বক্স -১২টি ও টর্চলাইট-১৬টি পেয়েছি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এগুলো নিয়ে আমরা ঘরে বসে থাকবো না। আমরা সিডিও ১২টি ইউনিয়নে ৬০ জন যুবককে নিয়ে দুর্যোগ রেসপন্স টিম গঠন করবো। দুদিনের একটি প্রশিক্ষণ কর্মশালা আয়োজন করবো। এগুলোর ব্যবহার সম্পর্কে তাদের ধারণা প্রদান করবো যাতে এগুলোর সঠিক ব্যবহার হয় এবং আমরা দুর্যোগ ঝঁকি কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।’
এ প্রসঙ্গে আরেকটি যুব সংগঠন এসএসএসটি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি আলী হোসেন বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত দুর্যোগের সাথে মোকাবেলা করে টিকে আছি। দুর্যোগের আগে ও পরে আমাদের নানান ধরনের সমস্যা তৈরি হতো। উপকরণের জন্য বিভিন্ন মানুষের কাছে চাইতে হতো এবং তা সময় মতো পাওয়া যেতো না। কিন্তু বারসিক’র নিকট থেকে এ উপকরণগুলো পাওয়াতে আমাদের অনেক বড় উপকার হলো। যেকোন দুর্যোগের সময় আমরা এগুলো ব্যবহার করতে পারবো। পাশাপশি বিভিন্ন সচেতনতামূলক কাজে ব্যবহার করতে পারবো। তাৎক্ষণিকভাবে দুর্যোগ থেকে পরিত্রাণের ব্যবস্থা করতে পারবো। এ উপকরণগুলো পাওয়াতে আমাদের মনে হলো যেন দুর্যোগের প্রতিরোধের সম্পদ ফিরে পেয়েছি। এছাড়াও দুর্যোগে উপকূলীয় মানুষের পাশে থাকতে পারছি এটাই বড় পাওয়া।’
প্রতিবছর উপকূলীয় এলাকায় ছোট বড় নানান ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ কম বেশি আঘাত হানছে এবং ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ততার শিকার হতে হচ্ছে। প্রতিবছর দুর্যোগে উপকূলীয় যুবরা নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তারা যে অবদান রাখছে তা কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করলে কোটি কোটি টাকা লাগতো। কিন্তু সেখানে আমাদের যুবরা নিজেদের স্বার্থ ত্যাগ করে দেশ ও জাতির কল্যাণে নিরলস ভূমিকা রাখছে। তাদের কাজকে তাদের উদ্যোগকে আরো বেগবান করার জন্য তাদের চাহিদাকে বিবেচনা করা খুবই জরুরি। তাদের আগ্রহ ও উদ্যোগকে সহায়তা করতে পারলে দেশ ও জাতির উন্নয়ন হবে।