এলাকা উপযোগি তিনটি শস্য জাত পেলেন হাওরের কৃষকরা
মদনের তলার হাওর থেকে সুমন তালুকদার
গত ১০ মার্চ ২০২১ রোজ বুধবার নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার হাওর অধ্যুষিত গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের গোবিন্দশ্রী গ্রামে কৃষক নেতৃত্বে পরিচালিত হাওর এলাকা উপযোগি শস্য ফসলের জাত নির্বাচনে প্রায়োগিক গবেষণার এক কৃষক মাঠ দিবস অনুষ্ঠিত হয়। বারসিক’র সহযোগিতায় আয়োজিত কৃষক মাঠ দিবসে উপজেলা সম্প্রসারণ কৃষি কর্মকর্তা রায়হানুল হক, উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা দিদারুল ইসলামসহ মদন ও গোবিন্দশ্রী দু’টি ইউনিয়নের ১১টি গ্রাম ও পাড়ার ৩৫ জন কৃষক-কৃষণী (নারী-১৫) অংশগ্রহণ করেন। মাঠ দিবসটি মূলতঃ সরেজমিনে ফসলের মাঠ পরিদর্শন, আলোচনা সভা ও ফসলের জাত নির্বাচনের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
প্রধান অতিথি উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রায়হানুল হক কৃষক মাঠ দিবসে প্রায়োগিক কৃষি গবেষণাধীন শস্য ফসলের প্লট পরিদর্শন করে বারসিক ও কৃষক সংগঠনের কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেন। মাঠ দিবসে অংশগ্রহণকারী কৃষক-কৃষাণীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘বারসিক এলাকার কৃষি এবং কৃষকদের উপকারের জন্য এ ধরণের গবেষণা করছে। গবেষণা থেকে হাওর এলাকার জন্য উপযোগি কোন জাত পাওয়া গেলে হাওরের কৃষকরাই লাভবান হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাওরের কৃষি ক্ষেত্রে সংঘঠিত দুর্যোগগুলো (আগাম বন্যা, খরা, কোল্ড ইঞ্জুরি) মোকাবেলায় রবি শস্য ফসল চাষের অনেক উপকারীতা রয়েছে। রবি শস্য খরা ও ঠান্ডা সহনশীল এবং আগাম বন্যার অনেক আগেই সংগ্রহ করা যায়, ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোন সম্ভবাবনা নেই, অল্প খরচেই চাষ করা যায়। ডাল জাতীয় ফসল এবং তৈল জাতীয় ফসলে তেমন সেচের প্রয়োজন হয়না, এ ধরণের ফসলগুলো খরা ও ঠান্ডা সহনশীল তাই ফলনে তেমন কোন সমস্যা হয়না। সকলের খাদ্য নিরাপত্তার জন্য এবং প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় বৈচিত্র্যময় শস্য চাষ করা খুবই প্রয়োজন। এতে একটি ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে অন্য ফসল দিয়ে ক্ষতি মোকাবেলা করা যায়।” হাওরের কৃষি ক্ষেত্রে দূর্যোগ মোকাবেলায় তিনি একক ফসল বোরো ধানের উপর নির্ভর না করে ধানের পাশাপাশি অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে অন্যান্য শস্য ফসল চাষের জন্য কৃষকদের পরামর্শ দেন। তিনি বারসিক’র সাথে থেকে সামর্থ্য অনুযায়ী কৃষকদেরকে কৃষি উপকরণ ও প্রযুক্তি সহযোগিতা দেয়ার আশ্বাস দেন।
কৃষি কর্মকর্তাসহ অংশগ্রহণকারী কৃষক-কৃষাণীরা প্রায়োগিক গবেষণাধীণ ১৭টি শস্য ফসলের প্লট পরিদর্শন করেন। কৃষকরা প্লটের ফসলের অবস্থা (গাছের অবস্থা, ফলন, রোগ-বালাই, ফলের পুষ্টতা ইত্যাদি) পর্যবেক্ষণ করে এলাকার জন্য উপযোগি (খরা সহনশীল, সার-বিষ কম লাগে, হাওরের মাটি উপযোগি, উৎপাদন খরচ কম) এমন ৩টি ফসলের জাত (মসুর, খেসারী ও মটরশুটি) নির্বাচন করেন। তিন জাতের ডাল ফসল খুবই কম খরচে ভালো ফলন হওয়ায় কৃষকরা আগামী রবি মৌসুমে বেশি পরিমানে ডাল ফসল চাষ করার আগ্রহ প্রকাশ করেন এবং বারসিক ও কৃষি বিভাগের নিকট থেকে বীজ সহায়তা কামনা করেন।
গোবিন্দশ্রী বালই পাড়ের কৃষক সংগঠন’র সভাপতি কৃষক জাকির হোসেন বারসিক’র প্রতি কতজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, ‘বারসিক আমাদের গ্রামে সভা করে কৃষকদের অধিকার রক্ষা এবং কৃষকদের কথা ও দাবি-দাওয়া সংশ্লিষ্ট বিভাগে তুলে ধরার জন্য কৃষকদেরকে সংগঠিত হওয়ার পরামর্শ দেয়। বারসিক’র পরামর্শে আমরা ‘বালই পাড়ের কৃষক সংগঠন’ নামে একটি সংগঠন গড়ে তুলেছি। আমরা বারসিক’র নিকট থেকে সরিষা বীজ সহযোগিতা নিয়ে চলতি রবি মৌসুমে গ্রামের প্রায় সকলেই সরিষা চাষ করেছি। সরিষার ফলনও ভালো হয়েছে। সরিষা চাষ করে সরিষা ফলনের পাশাপাশি জ্বালানির লাকড়িও পেয়েছি। যারা এবার সরিষা চাষ করেনি তারাও আগামীতে সরিষা চাষ করার জন্য আমাদেরকে বীজ রাখতে বলেছে। আগামী রবি মৌসুমে আমরা বালই পাড়ের জমিতে সরিষা ও ডাল জাতীয় ফসল চাষ করবো।’
এর আগে মাঠ দিবস অনুষ্ঠানের শুরুতে বারসিক প্রতিনিধি সুমন তালুকদার অংশগ্রহণকারী কৃষি কর্মকর্তাসহ সকল কৃষক-কৃষাণীদেরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে রবি মৌসুমের শস্য ফসলের প্রায়োগিক গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। তিনি হাওরের কৃষি ক্ষেত্রে দুর্যোগ মোকাবেলায় বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষের গুরুত্ব কৃষকদের নিকট তুলে ধরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধান ফসলের ক্ষতি মোকাবেলায় বিকল্প ফসল হিসেবে রবি শস্য ফসল চাষের উপর গুরুত্বারোপ করেন।
অনুষ্ঠান শেষে অংশগ্রহণকারী কৃষকরা মসুর, খেসারী ও মটরশুটির বীজ পাওয়ার জন্য তলার হাওর কৃষক সংগঠন ও বারসিক’র নিকট চাহিদা দেন।