জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কেঁচো কম্পোস্টের বিকল্প নেই
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের আয়োজনে নেত্রকোনা কর্মএলাকার জৈব চাষিদের অংশগ্রহণে করোনাকালীন সংকটে বর্তমান প্রজন্মের কৃষক-কৃষাণীদেরকে জৈব ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে উদ্বুদ্ধকরণে গতকাল এক অনলাইন মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বারসিক’র কর্মসূচি কর্মকর্তা মো. আলমগীর এর সঞ্চালনায় সভায় জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনকারী কৃষক-কৃষাণী ও বারসিক’র কর্মীসহ ৩৬ জন অংশগ্রহণ করেন।
শুরুতে বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ্বাস স্বাগত বক্তব্যে অনলাইন মতবিনিময় সভার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলে ধরেন। তিনি করোনাকালীন সংকটে বিশেষভাবে করোনা থেকে সুরক্ষায় শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিরাপদ খাদ্যের গুরুত্ব তুলে ধরে জৈব উপায়ে ফসল চাষের জন্য অংশগ্রহণকারীদেরকে উৎসাহিত করেন।
অনলাইন মতবিনিময় সভায় বারসিক নেত্রকোনা অঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলা থেকে (আটপাড়া, নেত্রকোনা সদর, কলমাকান্দা, মদন, কেন্দুয়া, গৌরিপুর, তারাকান্দা) কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনকারী ও জৈব চাষিগণ তাদের কর্ম অভিজ্ঞতা পরস্পরের সাথে সহভাগিতা করেন। চল্লিশা আইপিএম কৃষক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও বাণিজ্যিকভাবে কেঁচো ও কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনকারী জৈব কৃষক আকবর হোসেন বাদশা মিয়া কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন পদ্ধতি, ব্যবস্থাপনা ও জৈব উপায়ে শাকসবজি চাষের অভিজ্ঞতা বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বারসিক’র দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রথম কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন আরম্ভ করি। কেঁচো কম্পোস্ট দিয়ে চাষকৃত আমার সবজি ক্ষেত দেখে গ্রামের অন্যরাও আমার কাছ থেকে শিখে ও কেঁচো নিয়ে প্রথমে সিমেন্টের রিং এবং পরে পাকা হাউজ করে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে জমিতে ব্যবহার করছেন। আমাদের রাজেন্দ্রপুর গ্রামে বর্তমানে ৩০ জন কৃষক কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করে জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘উপজেলা কৃষি অফিস থেকে আমাদের রাজেন্দ্রপুর গ্রামকে কম্পোস্ট গ্রাম হিসেবে ঘোষণা করেছে। আমরা সাংগঠনিকভাবে গ্রামের কৃষকদের উৎপাদিত কেঁচো ও কম্পোস্ট বিক্রি করছি। উৎপাদিত সবজি ফসলও সাংগঠনিকভাবে আমরা বিক্রি করি। নিজ গ্রাম বা বাইরের গ্রামের কোন কৃষক কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করতে চাইলে আমরা তাকে উৎপাদন পদ্ধতি শিখিয়ে বিনামূল্যে কেঁচো দিই। আবার অনেক সময় নিজ খরচে কৃষকদের বাড়ি গিয়ে কম্পোস্ট উৎপাদনের জন্য সহযোগিতা করি।’ তিনি কম্পোস্ট উৎপাদন করতে গিয়ে একটি সমস্যার কথা বলেন, সেটি হলে কম্পোস্ট সংগ্রহ করার উপযোগি হলে হাত চালুনি দিয়ে কেঁচো, কেঁচোর ডিম ও কম্পোস্ট আলাদা করা কষ্টকর। তিনি কম্পোস্ট চালার জন্য মেশিন বা দ্রæত চালা যায় এমন উপকরণের সন্ধান কারো নিকট থাকলে জানানোর আহবান জানান।
সীমান্ত এলাকার (লেঙ্গুড়া) আদিবাসী কৃষক মথি ঘাগ্রা বলেন, ‘আমি ২০১৫ সাল থেকে বারসিক থেকে প্রশিক্ষণ ও উপকরণ সহযোগিতা নিয়ে প্রথমে চাড়িতে এবং কেঁচো কম্পোস্ট দিয়ে সবজি চাষ করে ভালো লাভবান হওয়ায় পরবর্তীতে পাঁকা হাউজ করে কম্পোস্ট উৎপাদন করে বছরব্যাপী জৈব উপায়ে নিরাপদ সবজি চাষ করে নিজে খাচ্ছি এবং বাজারে ভোক্তাদের খাওয়াচ্ছি।’ তিনি বেশি পরিমাণে কম্পোস্ট উৎপাদন করতে কলাগাছ, পঁচা খড় ও কচুরিপানা গোবরের সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করার পরামর্শ দেন। তার মতে, এতে কম্পোস্টের গুণগতমান অনেক ভালো হয়।
সীমান্ত এলাকার কৃষক আব্দুল মোতালিব মিয়া বলেন, ‘আমি ২০১২ সালে বারসিক’র কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হয়ে ২০১৩ সাল থেকে প্রথমে চাড়িতে এবং পরবর্তীতে পাঁকা হাউজ করে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন করছি। আমি নিজে ব্যবহারের পর উদ্বৃত্ত¡ কেঁচো ও কম্পোস্ট বিভিন্ন মৎস্য খামার, উপজেলা কৃষি অফিস, কারিতাস, ওয়ার্ল্ড ভিশনসহ বিভিন্ এনজিও ও উদ্যোগী কৃষকদের নিকট বিক্রি করি। আগ্রহী কৃষকদেরকে আমি বিনামূল্যে কেঁচো দিয়ে উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে শিখিয়ে দিই। আমি এযাবৎ এলাকার কৃষক-কৃষাণীসহ বিভিন্ন এনজিওর মাধ্যমে প্রায় দুই শতাধিক কৃষক ও কর্মীদের কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদন কৌশল, জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদ কৌশল, জৈব বালাইনাশক তৈরী ও ব্যবহার এবং বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। বাজারে আমার উৎপাদিত সবজির বেশ কদর রয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমি এলাকার সকল কৃষকদেরকে জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের পরামর্শ দিয়ে আসছি সব সময়। আমি বারসিক’র সহযোগিতায় এখন অনেক ভালো আছি। বারসিক’র সহযোগিতায় নার্সারি করে এবং কেঁচো কম্পোস্ট করে আমি চার রুমের একটি পাঁকা দালান ঘর করেছি এবং ভালো আছি। এখন আমার একমাত্র উদ্দেশ্য পরিবেশ, প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণ করে এলাকার পরিবেশ উন্নয়ন এবং নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করে মানুষের সেবা করা। করোনার সময়ে করোনা ভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে নিরাপদ খাদ্য সকলের জন্য জরুরি। জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কেঁচো কম্পোস্টের বিকল্প নেই।’
উল্লেখ্য যে, সভায় বারসিক’র প্রতিনিধি শংকর ¤্রং মতবিনিময় সভায় বিভিন্ন ধরণের কম্পোস্ট (কম্পোস্ট সার, কেঁচো কম্পোস্ট, সবুজ সার, কুইক কম্পোস্ট, লিকুইড কম্পোস্ট বা তরল সার, ট্রাইকোডার্মা ইত্যাদি) সম্পর্কে অংশগ্রহণকারীদের ধারণা দেন। মতবিনিময় সভায় মাটির দূষণমুক্ত করার উপায় সম্পর্কে কৃষকদের প্রশ্নের উত্তরে শংকর ¤্রং কৃষকদেরকে প্রতি শতাংশ জমিতে ৩ কেজি (তিন) হারে ধলোচুন জমি চাষের সময় প্রয়োগ করে কিছু দিন ফেলে রেখে পুনরায় জমি ভালোভাবে চাষ করে ফসলের বীজ বপনের পরামর্শ দেন। তিনি কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনের স্থান উঁচু (পানি জমবেনা এমন) ও ছায়াযুক্ত, রোদ, বৃষ্টি থেকে নিরাপদ এমন স্থান নির্বাচন করার পরামর্শ দেন। চাড়ি/রিং বা হাউজের উপর ভালোভাবে চালা দেয়া এবং কেঁচো ছাড়ার পর হাউজ বা রিং এর ভিতরে যাতে আলো প্রবেশ না করে সেজন্য উপরি ভাগে চটের বস্তা বা অন্য কোন জিনিস দিয়ে ঢেকে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তিনি নিয়মিত হাউজ পর্যবেক্ষণ করে বহি:শত্রæর আক্রমণ থেকে কেঁচোগুলোর নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখার পরামর্শ দেন।
অনলাইন মতবিনিময় সভায় আরো অভিজ্ঞতা সহভাগিতা করেন মদন উপজেলার কুলাউতি গ্রামের কৃষক শাহ্জাহান মিয়া, গোবিন্দশ্রী গ্রামের কৃষক শামছু মিয়া, নেত্রকোনা সদর উপজেলার বিশ্বনাথপুর গ্রামের কৃষাণী সালেহা আক্তার, শারমিন আক্তার, গাছগড়িয়া গ্রামের যুব কৃষক বায়োজিত, মাজহারুল ইসলাম, তারাকান্দা উপজেলার সাধুপাড়া গ্রামের কৃষক আব্দুল লতিফ, কৃষক আব্দুল বারি, তাড়াটি গ্রামের কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদক, সংকরায়নের মাধ্যমে ধানের জাত উন্নয়নকারী, মধু চাষি এবং জৈব কৃষক মোশারফ হোসেন, কলমাকান্দার সলিতা চিসিম প্রমূখ।
মতবিনিময় সভার শেষ পর্যায়ে বারসিক’র অহিদুর রহমান এর নেত্রকোনা অঞ্চলে কৃষকদের জৈব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন কার্যক্রম এবং কেঁচো কম্পোস্ট উৎপাদনের উপর একটি ভিজুয়্যাল প্রতিবেদন প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেন।