৬০ বছরের ঘানি
রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার হরিদেবপুর গ্রামের মোঃ দাউদ হোসাইন (৭৫)। জীবনের শেষ সময়ে এসেও মুখে সবসময় তাঁর মিষ্টি হাসি থাকে। এর কারণ হচ্ছে তিনি মানুষকে দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে নিজের কাঠের ঘানি থেকে তৈরি তেল খাওয়ার ব্যবস্থা করেন। বাবার কাছ থেকে ১৫ বছর বয়সে শিখেছিলেন কাঠের ঘানি থেকে তেল উৎপাদনের প্রক্রিয়া। বাবা মারা যাওয়ার পর ৬০ বছর ধরে সংসারের ঘানিসহ বয়ে নিয়ে আসছেন বাবার দেওয়া তেলের ঘানিটাও।
একটি গরু দিয়ে তিনি প্রতিদিন ১০ কেজি লাল দেশি সরিষার ভাঙ্গান। সেখান থেকে প্রতিদিন ৫কেজি তেল উৎপাদন হয়। ভোর থাকতেই তিনি ঘানিতে গরু জুড়ে দিয়ে তেল বের করা শুরু করেন। বেলা ২-৩ টার দিকেই শেষ হয়ে যায়। এরপর তেল নিয়ে হাটে চলে যান। তেল বিক্রয় করে প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনে বাড়ি ফেরেন।
বর্তমান সময়ে খাদ্য ভেজাল বিষয়টি এমনভাবে চলছে যেন আসল পাওয়া ও চেনাই মুশকিল। সব কিছুতেই ভেজাল। কিন্তু মো. দাউদ হোসেন ৬০ বছর ধরে কোন ভেজাল না দিয়ে তেল তৈরি ও বিক্রয় করছেন। স্থানীয় হাটে তাঁর তেলের রয়েছে আলাদা পরিচিতি। তবে অন্য তেলের থেকে তাঁর তেলের দাম একটু বেশি। এর যৌক্তিক কারণও রয়েছে। তালন্দ হাট ও দড়গাডাঙ্গা হাটে এই তেল বিক্রয় হয় বেশি। নবজাতকে তেল মাখানোর কাজে এই তেল খুবই জনপ্রিয়। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ এই কাজের জন্যই হরিদেবপুর এসে তেল নিয়ে যায়। কারণ এটা খুবই উপকারী এবং দূষ্পাপ্য। একদম খাঁটি সরিষা থেকে তেল উৎপাদন হয় বলে এর খৈলের রয়েছে ব্যাপক চাহিদা। সারাবছর ৫৫ টাকা কেজি দরে বাড়ি থেকেই অন্য কৃষকরা পুকুরে ও গরুকে খাওয়ানোর জন্য খৈল কিনে নিয়ে যান। সরিষার দামে কম বেশিতে সারাবছর ২২০-৩০০ টাকা লিটার হিসেবে তেল বিক্রয় হয়। সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতিদিন তেল এবং খৈল থেকে ৭০০-৮০০ টাকা আয় হয়।
দীর্ঘ ৬০বছরের এই যাত্রায় আজ থেকে ২২ বছর আগে এই কাজে একটি বড় বাধা আসে বলে জানালেন মোঃ দাউদ হোসাইন। তিনি বলেন, ‘আমি একটি নতুন গরু কিনে আনলাম কিন্তু পরের দিন সকালে দেখি গরুটি ঘরেই মরে আছে। তখন আমার কাজ থমকে গেল। মনে হয়েছিল কাজটি চলমান রাখা আমার পক্ষে আর সম্ভব না। তখন নিজেই ঘানি টেনেছি আনেকদিন। এরপর অন্যের কাছ থেকে ধার করে আবার একটা গরু কিনে কাজটি চালিয়ে আসছি।’
সপ্তাহে ৬দিন চলে তেল উৎপাদন। সপ্তাহের একদিন শুক্রবারে তানোর উপজেলার বড় চৌবাড়িয়া হাট থেকে সরিষা কিনে আনার কাজে ব্যয় করেন। তেল বিক্রয় চলে সপ্তাহে চার দিন। তবে মো. দাউদ হোসাইন বলেন, ‘আমার বেশির ভাগ তেল বাড়ি থেকেই বিক্রয় হয়ে যায়। কারণ দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে আমি মানুষের বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি।’
তাঁর এক ছেলে পেশায় কৃষক হলেও এই কাজে রয়েছে বেশ আগ্রহ। তাঁর বাবার অবর্তমানে তিনি এই কাজ চালিয়ে নিতে চান বলে জানালেন। তবে বর্তমান সময়ে এসে বাবার অর্জিত বিশ্বাস ধরে রাখাই তাঁর কাছে বড় চ্যালেঞ্জ।
দীর্ঘ ৬০ বছর ধরে ঘানি ঘুড়লেও এখন ভাগ্যও চাকা ঘুরেনি বলে আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার জীবন ত শেষ খুব ভালো কিছু আমি আমার সন্তানের জন্য রেখে যেতে পারলাম না। যদি সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে আমাকে আমার কাজটি আরো বড় করার জন্য যদি কোন সহযোগিতা করত তাহলে আমার জন্য তা অনেক উপকারে আসবে।’