বীজ সংরক্ষণে জাহানারা বেগমের উদ্যোগ

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
কৃষির মূল ভিত্তি হলো বীজ। বীজ যদি ভালো না হয় তাহলে ভালো ফসল সম্ভব নয়। তাই ফসল লাগানোর আগে সঠিক এবং মানসম্মত বীজের প্রযোজন। কৃষকের কোন মৌসুমে কি ধরনের ফসল বা কতটা উৎপাদন হচ্ছে তা নির্ভর করছে অনেকটা বীজের উপর। তাই প্রত্যেক কৃষক সবসময় ভালো মানের বীজের সন্ধান করেন। সেটি বাজার থেকে সংগ্রহ, পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে আবার কখনো নিজ সংরক্ষণের মাধ্যমে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অন্যের কাছ থেকে কিংবা বাজার থেকে সংগ্রহ করা বীজে ভালো ফলন হচ্ছেনা। বাজার থেকে চড়ামূল্যে বীজ কিনলে সে বীজে কখনো-কখনো চারা গজাচ্ছে না, আবার চারা গজালেও ভালো ফলন হচ্ছেনা। আবার মোটামুটি হলে তা থেকে বীজ সংরক্ষণ করতে পারছেনা। এমন নানান সমস্যার মধ্যে দিয়ে দিশাহারা হয়ে এখনো গ্রাম বাংলার অনেক কৃষক-কৃষাণী বীজ সংরক্ষণ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চাালিয়ে যাচ্ছেন। তেমনই একজন নারী উপকূলীয় সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নেরর কৃষাণী জাহানারা বেগম। তিনি প্রায় ৯ বছর ধরে বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের বীজ সংরক্ষণে রাখছেন এবং বাড়িতে বছরব্যাপি নানা ধরনের ফসল চাষাবাদ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।


জাহানারা বেগম প্রতিবছর প্রত্যেক মৌসুমের বীজ বাড়িতে সংরক্ষণে রাখেন। আর সংরক্ষিত এ বীজ নিজে যেমন ব্যবহার করছেন তেমনি পাড়া প্রতিবেশি ও আত্মীয়স্বজনদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরণ করেন। তার বাড়িতে এখন ঢেড়স, পুইশাক, ধুন্দল, মেনকা, তরুল, লালশাক, পালনশাক, ওল, কচুরমুখি, ডাটাশাক ও বেগুনের বীজ আছে।

এ বিষয় জাহানারা বেগম বলেন, ‘বাড়িতে বীজ রাখার আনন্দ আলাদা। বাড়িতে বীজ থাকলে তার সুবিধা অনেক বেশি। যখন খুশি তখন লাগানো যায় এবং সঠিক সময়ে লাগিযে ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। আমি এখন যত রকমের বীজ রাখা সম্ভব তত রকমের বীজ সংরক্ষণ রাখার চেষ্টা করি। বিগত সময়ে আমি বাজার থেকে বীজ কিনে ঠকেছি। একবার মিষ্টিকুমড়া ও লাউয়ের বীজ বাজার থেকে কিনে লাগাই সেখানে শুধু গাছ বাড়ে কিন্তু কোন ফল হয়নি। এভাবে একবার ডাটাশাক কিনে দেখি সেটা অন্য শাক। এভাবে বারবার ক্ষতির শিকার হতে হতে এখন নিজে বীজ রাখি এবং ভালো ফলন পাই।’

তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমান আমার ক্ষেতে বেগুন, টমেটো, আলু, পাতাকপি, ফুলকপি, বীটকপি, শিম, ধনিয়া, পেঁয়াজ, রসুন, ঝাল জাতীয় সবজি আছে। তারই মধ্যে শুধু কপি জাতীয সবজি ছাড়া বাকী সবগুলো আমার বাড়ির বীজ। আর এ বীজ সংরক্ষণ আমি আমার নিজের জ্ঞান-অভিজ্ঞতা ও দক্ষতাকে কাজে লাগিযে করে যাচ্ছি। আমি বীজ রাখার ক্ষেতে গাছের ভালো ফলটা বীজ হিসাবে চিহ্নিত করি এবং সেটি গাছে পাকিয়ে ভালোভাবে রোদ শুকিযে কাচের বোতল বা ঔষধি বোতলের মধ্যে সংরক্ষণ করি এবং মাঝে মধ্যে বের করে রোদে শুকিযে নিই।’

জাহানারা বেগম জানান, তিনি বাড়িতে জৈব পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদ করার চেষ্টা করেন। তাঁর জমি-জমা বলতে মোট এই ১০ কাঠা জায়গা। স্বামী, স্ত্রী, দুই ছেলে ও ছেলের বৌ মিলে ৬ জনের পরিবার। বড় ছেলে আলাদা থাকে। ১০ কাঠা ভিটায় তিনি বারোমাস বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ করেন। শুধু সবজি নয়; তিনি সবজির পাশাপাশি দেশীয় হাঁস-মুরগি, ছাগল পালন করেন। তাঁর বাড়িতে এখন মুরগি আছে ১২টি, মেরি হাঁস ৭টি, রাজহাঁস ৫টি, ছাগল আছে ৪টি।

তিনি বলেন, ‘আমি আমার নিজের মতো করে যেমন ফসল উৎপাদন করি। তেমনি ফসলের বীজ সংরক্ষণ রাখি এবং বীজ ও সবজি আত্মীয়স্বজনদের মাঝে বিনামূল্যে সহায়তা করি। আমি আরো বেশি বেশি করে বীজ উৎপাদন এবং সংরক্ষণ করতে চাই। কিন্তু পানির সমস্যার কারণে সম্ভব হয়না। তাই বারসিক’র নিকট আমি বীজ সংরক্ষণের উপকরণ সহায়তার পাশাপাশি পানি সেচের জন্য একটি মটর সহায়তার প্রস্তাব জানাচ্ছি। এই সহায়তা পেলে আমি ভালো সবজি উৎপাদন করতে পারবো তেমনি বীজ সংরক্ষণ রাখতে পারবো।’

প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে উপকূলীয় জনগোষ্ঠী নানান ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করছেন এবং বাস্তবায়ন করছে। তেমনই একজন নারী জাহানারা বেগম। তার চাহিদা অনুযায়ী প্রযোজনীয় সহায়তা করা হলে তার বাড়িটি একটি আদর্শ কৃষি বাড়ি রূপান্তরিত হবে এবং স্খানীয় বীজ সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

happy wheels 2

Comments