মাটির কাজ করে স্বচ্ছলতা এসেছে নমিতা রানীর সংসারে
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
আমাদের দেশের মাটিতে সোনা ফলে-কথাটি চিরন্তন সত্য। কৃষকগণ চাষবাস করে ফসল ফলায় অন্যদিকে কুমার সম্প্রদায়ের মানুষেরা মাটি দিয়ে বিভিন্ন উপকরণ তৈরি করেন। এই দুই শ্রেণির মানুষের কাছে মাটি অত্যন্ত মূল্যবান সম্পদ।
মাটির তৈরি উপকরণ আমাদের দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী উপকরণ। অনেক বছর আগে থেকেই এর ব্যবহার হয়ে আসছে। যখন স্টিল ও প্লাস্টিক সামগ্রী ছিলনা তখন কাঁসা বা পিতলের পাশাপাশি মাটির উপকরণ ব্যবহৃত হতো। রেফ্রিজারেটরের ঠা-া পানির বিকল্প ছিল মাটির কলসের পানি। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে মাটির কলস, হাঁড়ি, সানকি ইত্যাদির ব্যবহার হতো।
সময়ের বিবর্তনে মাঝে কিছু বছর এই মৃৎশিল্প প্রায় বিলীন হতে বসেছিল। তবুও কুমার সম্প্রদায়ের মানুষদের কাজ থেমে থাকেনি। তাঁরা তাঁদের পেশা টিকিয়ে রাখার জন্য সংগ্রাম করে চলেছেন। গ্রামীণ লোকসংস্কৃতির অংশ হিসেবে বারণী মেলা, রথের মেলা, পহেলা বৈশাখ, অষ্টমী ¯œানের মেলা ইত্যাদি সময়ে তাঁদের তৈরি জিনিস বিক্রির উদ্দেশ্যে বাজারে বাজারে ঘুরেছেন। উপকরণগুলো আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য করেছেন বিভিন্ন রঙ এর ব্যবহার। ক্রেতার চাহিদা পূরণ ও নিজের অভাব দূর করার জন্য তাঁরা কাজ করে যাচ্ছেন।
কুমার সম্প্রদায়ের একজন নারী নমিতা রানী পাল। তিনি আটপাড়া উপজেলার বানিয়াজান ইউনিয়নের বাখরপুর গ্রামে বাস করেন। স্বামী, দুই ছেলে, ছেলের বৌ ও এক মেয়ে নিয়ে তাঁর সংসার। স্বামী মাটির কাজ করেন। বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে এসে তিনিও মাটির কাজ শুরু করেন। বাবার বাড়িতেও সবাই মাটির কাজ করতো। সেখানেই নমিতা কিছু উপকরণ বানাতে শিখেছিলেন। তখন অবশ্য শখের কারণে বাবার সাথে পুতুল, খেলনা ইত্যাদি তৈরি করতেন।
নমিতা রানী যখন এই গ্রামে বৌ হয়ে আসেন তখন স্বামীর বাড়িতে একটি ঘর ছাড়া কিছুই ছিলনা। সংসারও চলতো টানাটানির মাঝে। তাই কিছুটা বাধ্য হয়েই তিনি হাতে মাটি তুলে নেন। সেই থেকে শুরু। তাঁর বিয়ে হয়েছে প্রায় তিরিশ বছর। এতো বছর যাবৎ মাটির কাজে তিনি বেশ অভিজ্ঞ হয়ে উঠেছেন। এই গ্রামে তিনিই সর্বোচ্চ ধরণের উপকরণ তৈরি করতে পারেন।
বিভিন্ন ধরণের পুতুল, খেলনা, কলস, হাঁড়ি, ঢাকনা, থালা, গ্লাস, জগ, মূর্তি ইত্যাদি তৈরি করেন নমিতা রানী। তবে হাঁড়ি, কলস ইত্যাদি তৈরি তিনি স্বামীর কাছে শিখেছেন। আর স্বামীকে শিখিয়েছেন খেলা, পুতুল তৈরি করতে। এইভাবে একে অপরের কাছে শিখে এখন প্রায় ১৫০ ধরণের উপকরণ তিনি তৈরি করতে পারেন। সারাবছর ধরে তিনি মাটির কাজ করেন। তবে বেশি ব্যস্ততা থাকে ফাল্গুন, চৈত্র, বৈশাখ ও আষাঢ় মাসে। কারণ বিভিন্ন মেলা থাকে এই সময়ে। তাছাড়া বছরের অন্যান্য সময় এই মেলাকে সামনে রেখে প্রস্তুতি চলে।
উপকরণ তৈরি করার জন্য নমিতা’দের মাটি কিনতে হয়। একটা নির্দিষ্ট জমি বা পতিত জায়গার মাটি আনুমানিক মূল্যে কিনে নেয়। তাছাড়া খড়, লাকড়িও কিনতে হয়। সেই আঠালো মাটি বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় থেতলে, নরম করতে হয়। তারপর হাতের সাহায্যে বা কোনো ছাঁচ ব্যবহার করে উপকরণ তৈরি করতে হয়। মাটির কাঁচা উপকরণগুলো আগুনে পোড়াতে হয়। এতে প্রায় ২৪ ঘণ্টা সময় লাগে। তারপর রঙ এর সাহয্যে বিক্রি করার উপযোগী করে তোলেন।
মাটির কাজ করে নমিতা রানী স্বামীর সাথে সংসারের হাল ধরেছেন। অভাবের সংসারে স্বচ্ছলতা এনেছেন। কিছু টাকা জমিয়ে প্রথমে একটি গরু কিনেছিলেন। বর্তমানে তাঁর চারটি গরু আছে। এছাড়া বেশ কয়েকটি গরু বিক্রি করেছেন। সংসার খরচের পাশাপাশি কয়েক বছর টাকা জমা করে প্রায় ১৭ কাঠা জমি বন্ধক রেখেছিলেন। সেই জমির ধান দিয়ে খাবারের চাহিদা পূরণ করার পাশাপাশি বিক্রিও করতেন।
এক সময় খড়ের ঘরটি মেরামত করার প্রয়োজন হলো। একটি মাত্র ঘরে পরিবারের সবাই থাকতেন। তাই নমিতা উদ্যোগ নিলেন একটি পাকা ঘর করার। বন্ধকের জমিগুলো ছাড়িয়ে সেই টাকা দিয়ে বড় করে পাকা ঘর তুললেন। এখন সবাই মিলে পাকা ঘরে থাকেন। এক বছর হলো তিনি ২.৫ কাঠা জায়গা কিনেছেন। সব করেছেন তিনি মাটির কাজ করে।
বাখরপুর গ্রামের মৃৎশিল্পীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রোজগার হয় তাঁর। কারণ নমিতা রানী সারাবছর নিয়মিতভাবে মাটির উপকরণ তৈরি করেন। তাছাড়া তাঁর স্বামী ও বড় ছেলে বিভিন্ন ধরণের প্রতিমা তৈরির কাজ করেন। বিভিন্ন মেলায় বিক্রি করা ছাড়াও তিনি স্থানীয় বাজারে এসব উপকরণ বিক্রি করেন। স্বামী ও ছেলে কাজের সাথে যুক্ত থাকায় বেশ ভালোভাবেই সংসার চলছে তাঁর।
যে শিল্পটি হারিয়ে যেতে বসেছিল সেই শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার নিরলস প্রচেষ্টা করে যাচ্ছেন নমিতা রানী পাল ও তাঁর পরিবার। বর্তমানে মাটির উপকরণের চাহিদা বেড়েছে। আধুনিক সময়ে মানুষ শখের বশে বাড়িঘর সাজানোর জন্য বিভিন্ন মাটির উপকরণ ব্যবহার করেন। এই উপকরণই কিছু পরিবারের বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ সম্বল। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে, হাতের সাহায্যে শিল্পকে ফুটিয়ে তোলেন নমিতা রানী পাল। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য বহনকারী এই শিল্প নমিতা রানীদের মতো মৃৎশিল্পীর হাত ধরে টিকে থাকবে অনন্তকাল।