ফতেমা খাতুন যেতে চান অনেক দূর…
সাতক্ষীরা শ্যামনগর থেকে বিধান মধু
সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর থানার বাদঘাটা গ্রামের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত ফতেমা খাতুন। যে বয়সে স্কুলে যাওয়া, পাড়ার মেয়েদের সাথে হৈ হুল্লোর করে স্বাধীনভাবে ঘুরে বেরানোর কথা তার কিছুই হয়নি তার। বাবার বাড়ির আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। তাইতো মাত্র ১৪ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়েছে তাকে। স্বামীর বাড়ির অবস্থাও তেমন ভালো ছিল না। ফতেমা খাতুন ভাবতে থাকেন কি করে স্বামীর সামান্য আয়ের পাশাপাশি সংসারে হাল ধরা যায়, কি করে ঘরে বসে অর্থ উপার্জন করা যায়? এরই মধ্যে তাঁর কোল জুড়ে আসলো এক ছেলে সন্তান। নতুন করে বাঁচার ও সফল হওয়ার তাড়না আরও ঘনীভূত হলো তাঁর। তিনি ঘরে বসেই অর্থ উপার্জনের একটা পথ আবিষ্কার করলেন। হাতের কাজের মধ্যেমে তিনি সংসারের জন্য কিছু আয় নিশ্চিত করার মনঃস্থির করলেন। সেলাই মেশিন কেনার জন্য তিনি ভাইয়ের সহযোগিতা নিয়ে এবং একটি গরু বিক্রি করে তিনি সেলাই মেশিন কেনেন। এভাবে শুরু হলো তাঁর সংগ্রাম।
সেলাই কাজের জন্য প্রয়োজন প্রশিক্ষণ। তিনি অর্থের বিনিময়ে সেলাইয়ের প্রাথমিক একটা প্রশিক্ষণ নিলেন। তবে আর্থিক সংকটের কারণে এই প্রশিক্ষণে তিনি ১৫ দিনের বেশি চালিয়ে যেতে পারেননি। এই ১৫ দিনে তিনি তেমন কিছু শিখতে পারলেন না। তারপরও তিনি ক্ষান্ত হননি। নিজেই নিজেকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করলেন। পুরানো জিনিস খোলা, দেখা আর তৈরি করার কাজে তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। এমনি করেই করে কেটে গেল প্রায় ১০ বছর। এভাবে নিজের প্রচেষ্টায় নারীদের প্রায় সব কাজই শিখে ফেলেন তিনি।
তাঁর সুনিপুণ হাতের কাজে আকৃষ্ট হয়ে এখন গ্রামের প্রায় সব নারীই তাঁর কাছে প্রতিনিয়ত ভীড় জমাচ্ছেন তাদের পোশাক তৈরি করানোর জন্য। সেলাই এর পাশাপাশি তিনি অনেক আড়িজুরির কাজও শিখেছেন। বর্তমানে তাঁর কাছে শুধুই পেশাক তৈরি করানোর জন্য নারীরা আসেন না; কাজ শিখতেও আসেন। একেক জন নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তিনি প্রায় ১৫০০ থেকে ২০০০ টাকার পারিশ্রামিক নেন। এমনকি তিনি বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও শিখিয়ে দিয়ে আসেন। এ যাবৎ তিনি প্রায় ২০ থেকে ২৫ জনকে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন বলে তিনি জানান।
বর্তমানে ফাতেমা খাতুন সেলাই এবং আড়িজুরির কাজ নিয়ে শ্যামনগর উপজেলা মহিলা সংস্থার সাথে যুক্ত আছেন। মাঝে মাঝে তিনি এখানকার প্রশিক্ষণর্াাথীদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন এবং নতুন নতুন কোন কিছুর উপর প্রশিক্ষণ থাকলে তাতে তিনি নিজে অংশগ্রহণ করেন। এ কাজ শিখে তার এখন মাসিক আয় প্রায় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা। হাতের কাজ শিখে তিনি দুই ছেলের পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক ছেলে কৃত্বিতের সাথে মাধ্যমিক পাশ করে উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছেন। অন্য ছেলে ইতিমধ্যে কৃত্বিতের সাথে জেএসসি পাশ করেছে। এ কাজের মাধ্যমে তার পরিবারের ভরণপোষণ ছাড়াও বসতবাড়ি আধাপাকা করে ঘরের অনেক আসবাবপত্র কিনেছেন। তাঁর দেখাদেখিতে গ্রামে অনেক নারী এখন হাতের কাজ শিখছেন।
ফাতেমা খাতুন ভবিষ্যতে কয়েকটি সেলাই মেশিন ও হাতের কাজের কিছু জিনিসপত্র কিনবেন এবং স্বল্প টাকার বিনিময়ে নিজ বাড়িতে দুঃস্থ ও গরিব নারীদের প্রশিক্ষণ দেবেন বলে জানান। এসব কাজের জন্য তিনি একটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খূলবেন। তাঁর মতে, কোন নারী যেন বসে না থাকেন, ঘরের কাজের পাশাপাশি যেন সবাই হাতের কাজ করে এগিয়ে যান।
ফাতেমা খাতুন প্রমাণ করেছেন সৎ চিন্তা ও অদম্য ইচ্ছাশক্তি থাকলে শত বাধা বিপত্তি অতিক্রম করা যায়। এ বিষয়ে বলতে গিয়ে ফতেমা খাতুন বলেন, “নিজে তো স্কুল কলেজের শিক্ষা অর্জন করতে পারিনি। তাই ছেলে দুটোকে এ কাজ করে মানুষের মতো মানুষ করে সমাজে মাথা উচু করে অনেক দূর এগিয়ে যেতে চাই।”