আবারও ‘মৌসুমী পতিত’ শিকার বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিজমি
রাজশাহী, তানোর থেকে অমৃত সরকার
বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষির ইতিহাস থেকে জানান যায় যে, এই এলাকায় অতীতে বৃষ্টিনির্ভর আমন ব্যতিত অন্য কোন ফসল চাষবাদ হতো না। মূলত পানির সমস্যার কারণেই অতীতে এই অঞ্চলের ৭-৮মাস জমিগুলো পতিত থাকত। রুক্ষ ও ধু ধু বরেন্দ্রর এই মাটিতে ফসল ফলানো এবং বৃক্ষরাজীতে পরিপূর্ণ করণের লক্ষে ১৯৮৫সাল থেকে বরেন্দ্র বহুমূখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) মাটির নিচ থেকে গভীর নলকুপ দ্বারা পানি উত্তোলন করে সেচ কাজ শুরু করে। বর্তমানে বিএমডিএর বরেন্দ্র অঞ্চলে ১৫ হাজার ১০০টি গভীর নলকুপ চালু আছে। দীর্ঘ সময় ধরে মাটির নিচ থেকে পানি উত্তোলনের ফলে এই এলাকার পানির স্তর ক্রমান্বয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। গভীর নলকূপ দ্বারা কিছু বছরের জন্য এই এলাকার জমিগুলো বোরো চাষের আওতায় এলেও বর্তমানে সেই জমিগুলো আবারও ‘মৌসুমী পতিত’ জমিতে শিকার হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তানোর, গোদাগাড়ি, পবা, নাচোল উপজেলার কৃষকরা মনে করছেন বৃষ্টিপাত কমে যাওয়া, গভীর নলকূপগুলোতে পানি কম উঠা এবং দিনের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া ইত্যাদি।
এই এলাকার কৃষকদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টার ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে অতীতের মত ৭-৮মাস জমি পতিত থাকে না। তবে বিশেষ করে বোরো মৌসুমে রাজশাহীর তানোর উপজেলার বাধাইর ইউনিয়ন, মন্ডুমালা পৌরসভার কিছু এলাকা, গোদাগাড়ি উপজেলা, চাঁপাই-নবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলা ও নওগাঁ জেলার পোরশা ও সাপাহার উপজেলার অধীকাংশ উঁচু-মাঝারি উঁচু জমিগুলো পানির অভাবে এখনও পতিত রয়েছে কিংবা বৃষ্টিনির্ভর আমন চাষের অপেক্ষায় আছে। এই বিষয়ে নাচোল উপজেলার বরেন্দ্রা গ্রামের কৃষক মোঃ আনিস উদ্দিন (৪৬) বলেন, “আমাদের গ্রামের সকল জমিতেই আজ থেকে ১০-১২ বছর আগে বোরোসহ সকল ধানই চাষাবাদ হতো, কিন্তু এখন ডিপ থেকে পানি না পাওয়ার কারণে আমাদের গ্রামের অনেক জমিই আমন চাষের অপেক্ষায় পরে থাকে।” এলাকার কৃষকরা জানান, তাদের এলাকায় আজ থেকে ৪-৫ বছর আগে এই সমস্যা খুবই বেশি দেখা দিেেয়ছে। তাই তাঁরা কমপানি প্রয়োজন হয় এমন রবিশস্য চাষাবাদ করতে শুরু করেন। আবার জমি থেকে রবিশস্য তুলে নিয়ে টি-আমন (আউশ) চাষ করেন। কারণ টি-আমনে পানি তুলনামূলক কম লাগে। তখন ভালো ফলন হতো বলে তারা জানান। কিন্তু বর্তমানে ডিপের পানি একেবারেই কম উঠছে তাই অনেক জমি এখন পরে আছে। বর্তমানে গ্রামের কষকরা কম পানির মুগ ও মাসকালই চাষ শুরু করেছেন। তারপরও গ্রামের উল্লেখযোগ্য উঁচু জমি এখনও পতিতই রয়েছে।
অন্যদিকে তানোর এলাকার বাধাইর ইউনিয়ন ও মন্ডুমালা পৌরসভার কিছু এলাকায় পানির স্তর অনেক নিচে হওয়ার কারণেই এই এলাকায় বোরো ধান চাষ অনেক কমে গেছে। কৃষকরা রবিশস্য চাষাবাদের দিকে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। মন্ডুমালা পৌরসভার সাতপুকুরিয়া গ্রামের প্রবীণ কৃষক মো. পিন্টু মিয়া (৫৮) এই প্রসঙ্গে বলেন, “বর্তমানে আমাদের এলাকায় শুধু ডিপের নিকটের জমিতেই বোরো ধানের চাষ হচ্ছে। বাকি কিছু জমিতে মাসকালাই চাষ হলেও অন্য অনেক জমি পতিতই থাকছে।” একই উপজেলার বাধাইড় ইউনিয়নের ঝিনাখোর গ্রামের আদিবাসী কৃষি শ্রমিক সুনিল কিস্কু (৪৫) বলেন, “বিগত ১৫-২০ বছর আগেও এই এলাকায় ইুরি (বোরো) ধানের চাষ হতো। পাশাপাশি সারাবছরই জমিতে কোন না কোন ফসল থাকতো। তাই সারাবছরই আমাদের কাজ থাকতো। কিন্তু বর্তমানে আমাদের গ্রামের আশেপামের ডিপগুলোতে আর আগের মতো পানি না উঠার কারণে খুব অল্প পরিমাণে ইরি (বোরো) ধানের চাষ হয়। বাকি অনেক জমি এখন পরে থাকে। তাই কাজেরও অভাব হয়।” এই গ্রামের অপর কৃষি শ্রমিক জোগেশ মূর্মূ বলেন, “মূলত খাওয়া ও দৈনন্দিন কাজে পানির অভাব ও কাজ না থাকার কারণে আমাদের এলাকা থেকে বৈশাক-জ্যৈষ্ঠ মাসে অনেক মানুষ পাশের মহোনপুর, পবা, মহাদেবপুর, আত্রাই, রানীনগর উপজেলায় পরিবার পরিজন নিয়ে মৌসুমী স্থানান্তর হয়। কারণ সেখানে এই সময়ে ধান কাটার জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন হয়।”
এদিকে গোদাগাড়ি উপজেলার প্রায় পুরোটাই বরেন্দ্র অঞ্চলের বৈশিষ্ট্যই ভরপুর। এই উপজেলার সব জমিই প্রায় উঁচু, নিচু সিঁড়ির মত। বিএমডিএর কল্যাণে এই এলাকাতেও বেশির ভাগ জমিতে বোরো ধানের আবাদ শুরু হয়। কৃষকরাও বোরো ধানচাষে অভ্যস্থ হয়ে ওঠেন। এক পর্যায়ে ডিপগুলো থেকে পানি কম উঠতে শুরু করলে কৃষকরা একটি ডিপের আওতাধীন জমিকে ভাগ করে নিয়ে চাষাবাদ শুরু করেন। এ বিষয়ে গোগ্রাম ইউনিয়নের বটতলী গ্রামের প্রবীন কৃষক মো. মনসুর আলী (৭২) বলেন, “প্রথম যখন আমাদের গ্রামের ডিপ বসানো হয় তখন একটি ডিপের পানি সেচ দেওয়ার ক্ষমতা ছিল ৩০০-৩৫০ বিঘা জমি। কিন্তু ৫-৭ বছর থেকে তা ক্রমান্বয়ে কমতে থাকে। বর্তমানে তা ৮০-১০০ বিঘা জমিতে এসে ঠেকেছে। তাই আমাদের গ্রামের সকল কৃষক মিলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, আমরা পালাক্রমে ডিপ থেকে পানি নিয়ে ধান চাষ করবো।” তিনি আরও বলেন, “প্রথমবার যে জমিতে পানি সেচ দেওয়া হবে দ্বিতীয়বার অন্য জমিতে পানি সেচ দেওয়া হবে। তবুও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম পানি সরবরাহ করতে পারছে ডিপগুলো। তাই আমরা রবিশস্য চাষে মনোনিবেশ করেছি। কিন্তু এই রবিশস্য চাষ শেষ হলে পানির অভাবেই অনেক জমি পতিত থাকে। যা আমরা নাম দিয়েছি ‘মৌসুমী পতিত’ জমি।
বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য সরকার নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, কৃষিকাজের জন্য আর ভূ-গর্ভস্থ থেকে পানি উত্তোলন করবে না। এ থেকেই বোঝা যায় পানি সমস্যা এ অঞ্চলের জন্য কতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। কৃষির সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই মনে করছেন, এই এলাকার জন্য রবিশস্যসহ যে সকল ফসলে পানি কম প্রয়োজন হয় সে সকল ফসলের সম্প্রসারণ ঘটানো প্রয়োজন। পানির অভাবের কারণেই এই অঞ্চলের অনেক জমি পতিত রয়েছে। মূলত রবিশস্য চাষ পরবর্তী সময়ে বরেন্দ্র এলাকার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খরার কারণেই জমিগুলো রস ধারণ ক্ষমতাশূন্য হয়ে পড়ছে। এই কারণেই উল্লেখযোগ্য হারে বিগত সময়ের মত মৌসুমী পতিত হচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিজমি।