এসো মুক্তিযোদ্ধার গল্প শুনি-১

বাবার জমানো টাকা চুরি করে যুদ্ধে যান মানিকগঞ্জের খোরশেদ মিয়া

বাংলাদেশ ‘নামক’এই রাষ্ট্রের জন্ম লাভ করার পেছনে অনেক মানুষের ত্যাগ, তিতীক্ষা ও অবদান ছিলো। ১৯৭১ সালে নিজেদের সবকিছু উজাড় করে দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছেন অনেক মানুষ। কেউ তাদের এই ত্যাগ ও বীরত্বের স্বীকৃতি যেমন পেয়েছেন, কেউ আবার এখনও স্বীকৃতি পাননি। তবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার স্মৃতিকে ধরে রেখে এখনও বেঁচে আছেন, প্রত্যাশা করেন প্রাপ্য স্বীকৃতি লাভ করার। বাংলাদেশে আনাচে, কানাচে এখনও অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন যাঁরা এখনও রাষ্ট্রসহ অনেকের কাছে অপরিচিত। এই লেখায় আমরা তেমনই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার কথা জানবো যিনি দেশের প্রতি ভালোবাসা ও অনুরাগস্বরূপ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং দেশকে স্বাধীন করতে অবদান রেখেছিলেন। বারসিক নিউজ.কম এর মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি আব্দুর রাজ্জাক-এর উপস্থাপনায় আমরা মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ মিয়ার সেই গল্প শুনি:

আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। দেশ মাতৃকার স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পেরে আমার জীবন ধন্য। আমি ভারতে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি। বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম। ভারতে যেতে পদে পদে বিপত্তির মধ্যে পড়তে হয়। প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফিরতেও একই অবস্থা। একদিকে পাক-হানাদার বাহিনী অন্য দিকে রাজাকার বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে আসা-যাওয়া। এসে যশোর ও ফরিদপুরে বেশ কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। পরাজিত করেছি পাক সেনাদের। এরপর দেশ স্বাধীন হলো। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও আজও মেলেনি তার মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি। জীবনের পড়ন্ত বেলায় মনের ভিতরে এই তীব্র ব্যাথাটা চেপে রেখে কথাগুলো বললেন, মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার বানিয়াজুরী ইউনিয়নের কড়চাবাঁধা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মো. খোরশেদ মিয়া (৬৬)। খোরশেদ মিয়া তাঁর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কাহিনী তুলে ধরে এভাবেই এই প্রতিবেদককে বলতে থাকেন।

উত্তাল ১৯৭১ সাল। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই এলাকাজুড়ে নানা গুঞ্জন, থমথমে পরিস্থিতি। এ ঘটনার পর এলাকার রাস্তাঘাট খালি হয়ে যায়। গ্রামের সহজ সরল মানুষের মনে অজানা আতংক বিরাজ করে। মধ্য রাতের আগেই পাকহানাদার বাহিনী রাজধানী জুড়ে গণহত্যা শুরু করে দেয়। রাজধানীর কাছের জেলা বলে সেই ঘৃণ্য বর্বর হামলার খবর মানিকগঞ্জে পৌঁছাতে দেরি হয়নি। গণহত্যার খবরের সাথে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস্ আর ইপিআর পিলখানার প্রতিরোধ যুদ্ধের খবরও জেনে যান রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।

01 (1)

খোরশেদ মিয়া বলেন, একদিন আমার বাবা রহিম উদ্দিন মিয়া (ভাজন) বারান্দায় বসে ভাত খাচ্ছেন। আমিও পাশে বসে খাচ্ছি। পাশের এলাকার একজন মুক্তিযোদ্ধা ভারতে ট্রেনিং এর জন্য যাচ্ছে, বাবা আফসোসের সুরে বললো, আমার যদি আর একটা ছেলে থাকত তাহলে মুক্তিযুদ্ধে পাঠাতাম। তখন আমার বাবা ওয়েস্ট পাকিস্তানে আর্মিতে চাকুরী করতেন।

বাবার কথাটা আমার মনে ধাক্কা দিল। তখন বঙ্গবন্ধুর আহবানে সারাদেশ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া শুরু করল, আমিও চিন্তা ভাবনা করলাম আমি মক্তিযুদ্ধে যোগ দিব। আমি তখন কৌড়ি কলেজে আই.এ সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার জন্য যখন সিদ্ধান্ত নিই, তখন হাতে টাকা ছিল না। বাবার জমানো কিছু টাকা চুরির করলাম। পরে এ বিষয়ে কথা হয় আমার পাশের গ্রাম গোয়ালডাঙ্গীর ওয়াজেদ আলী দেওয়ানের সঙ্গে।

পাশ্ববর্তী বরংগাখোলা গ্রামের সিরাজুল মাস্টার এর নেতৃত্বে ওয়াজেদ দেওয়ান আর আমি তার বাড়ি থেকে আমরা কিছু ট্রেনিং নিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করার পর একটি খবর এলো আমাদের যেতে হবে। তখন এমপি সিদ্দিক সাহেব ছিলেন ভারতের মুক্তিযোদ্ধা কল্যানির ক্যাম্পের দায়িত্বে।
সিদ্ধান্ত নিলাম আজ রাতেই রওনা দেব। মাকে জানাব না। কারণ মা কিছুতেই যেতে দিতে চাইবে না। কারণ আমি ছিলাম বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাই হল। কথামতো সেদিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রওনা দিই।

01 (2)

২৫ শে মার্চের পরে আমরা ২০ জন সবাই সিরাজুল মাস্টারের নেতৃত্বে নবগ্রামের কেরিয়া নৌকা নিয়ে গেলাম রূপসা নালী এলাকায়। আরো ৭০ থেকে ৮০ জন যাবে। পদ্মার পাড়ে ধুলসুরা এক মাদবর বাড়িতে গেলাম। ওখান থেকে আমরা ছানদি নৌকায় পার হব। তখন পাকসেনারা পদ্মার পারে টহল দিচ্ছিল। তখন সিরাজুল মাস্টার আমাদের বললো, তোরা ভয় পাইসনা। সাহস নিয়ে ছানদিতে চড়লাম। ব্রাস ফায়ারে পদ্মার নদীর চরে বড় বড় নৌকা ডুবে আছে আর শত শত লাশগুলো পার ঘেঁষে ভাসছে। চোখের সামনে এমন দৃশ্য দেখে আতকে উঠলাম। পরে আমরা আস্তে আস্তে আসতে পার হতে লাগলাম। এরপর পায়ে হেঁটে সরাসরি ভারতের মক্তিযোদ্ধা কল্যানির ক্যাম্পে চলে গেলাম। হেটে যেতে সময় লাগলো নয় দিন। মানিকগঞ্জের ব্যাংকার বীরমুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ আলী আমরা এক সাথে ছিলাম, এক বিছানাতেই থাকতাম। আমাদের খাবার দিত বড় বড় রুটি আর ফল।

এভাবে ২২ দিন আমাদের ট্রেনিং চললো। কিছুদিন পর আমাদের ডাক পড়লো যেতে হবে যশোর। সরাসরি ৮ নাম্বার সেক্টরে যোগ দিলাম। মেজর জেনারেল মঞ্জুর সাথে কয়েকটি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। সেখান থেকে মেজর জেনারেল মঞ্জুর নির্দেশে চলে গেলাম ভাটিয়াপাড়া। ভাটিয়াপাড়া ৪-৫ দিন থাকার পর ওখান থেকে আবার আমাদের নির্দেশ দিলো, তোমরা ফরিদপুর বোয়ালমারি চলে যাও। আমরা অস্ত্রপাতি নিয়ে গরুর গাড়ি ও ঘোড়ার করে বোয়ালমারি গেলাম। ব্যাঙ্কার তৈরি করে অস্ত্রপাতি তার মধ্যে রেখে দিলাম। ওখানে এক চেয়ারম্যান আমাদের খাবার দাবার দিয়ে সাহায্য করল। ৬-৭ দিন ছিলাম। আমাদের সাথে যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পন করে। ওখান থেকে চলে গেলাম ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে। সেখানে সব পাক বাহিনী আত্মসমর্পন করে তাদেরকে আটক করে রাখি।

সেখানে তাবু টানিয়ে ১০-১২ দিন থাকার পর লেফটেনেন্ট জামাল চৌধুরি আমাদের সবাইকে একটি সনদ দিয়ে যার যার এলাকায় চলে যেতে বললেন। আমরা সবাই ওখানে অস্ত্রপাতি জমা দিয়ে চলে এলাম। ওই সময় বেতারে ঘোষণা শুনলাম নিয়াজী আসমর্পন করে হেলিকপ্টারে ওয়েস্ট পাকিস্তানে নিয়ে যাচ্ছে। মানিকগঞ্জে চলে আসলাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন হাবুু মিয়ার বাড়িতে সবাইকে ডাকলো আমরা সবাই সেখানে গেলাম। সেখানে মানিকগঞ্জের মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হালিম চৌধুরি ছিলেন।

01 (3)

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুলিশে নিয়োগ দিল। আমি পুলিশে চাকুরি নিয়ে চলে গেলাম ময়মনসিংহ। সেখান থেকে বদলি হয়ে ঢাকায় চলে এলাম এসবিতে। পরে গণভবনে ডিউটি করতাম তখন ১৯৮৪-৮৫ সালে এরশাদ সাহেব রাষ্ট্রপতি, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেব ছিলেন মহাসচিব। তখন আমার ডিউটি পরে আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সাহেবের গানম্যান হিসেবে। এক টানা ১৭ বছর ছিলাম তার গানম্যান।

গোয়ালডাঙ্গী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ওয়াজেদ আলী দেওয়ান বলেন, আমরা ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে খোরশেদ ভাইয়ের সাথে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি। জীবন বাজি করে দেশ স্বাধীন করেছি। আমরা মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাইনি। সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মানি ভাতাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করলেও সব কিছু থেকে আমি বঞ্চিত হচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের সরকার চাকরির সুযোগ দিলেও আমার একটা ছেলে-মেয়েকে চাকরি দিতে পারলাম না।

মুক্তিযোদ্ধা খোরশেদ মিয়া বলেন, চার মেয়ে বিয়েশাদী দিয়েছি। স্ত্রী ও এক ছেলে নিয়ে আমার সংসার। জীবনের তাগিদে ছেলে এখন অন্যের দোকানের কর্মচারী হিসেবে কাজ করে। জীবনে অনেক কিছু পেয়েছি, অনেক কিছু হারিয়েছি। শুধু আফসোস, জীবন বাজি করে দেশ স্বাধীন করেও তার স্বীকৃতি না পাওয়া। তবে নতুন যাচাই-বাছাই কমিটিতে তার নাম অর্ন্তভুক্ত হয়েছে। এবার অপেক্ষা চূড়ান্ত স্বীকৃতি পাওয়ার।

নিজের জীবন তুচ্ছ করে মাতৃভূমিকে পৃথিবীর বুকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করার এই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতিময় সম্মানটুকু কি তাদের প্রাপ্য নয়?

happy wheels 2

Comments