তবুও জীবন যাচ্ছে কেটে জীবনের নিয়মে
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে কত সংগ্রাম করতে হয়। কত সংকুল পরিস্থিতির মোকাবেলা করে টিকে থাকতে হয়। পারিপার্শ্বিক অবস্থা মেনে নিয়ে নিজের মনের সাথেও যুদ্ধ করে যেতে হয়। সংসারের চাহিদা পূরণের জন্য পথে নামতে হয়। কবে কোন কষ্ট পেয়েছি, কে ব্যথা দিয়েছে সে সব মনে রাখলে জীবন চলবেনা।
দিন যাপনের জন্য আমাদের দেশের মানুষেরা নানা ধরণের কাজের সাথে নিজেকে যুক্ত করেন। সেই কাজ করে যে অর্থ পান তা দিয়ে কোনো রকমে সংসার চালান। কেউ বড় চাকুরে, কেউ ব্যবসা করে আবার কেউবা ন্যুনতম অর্থের বিনিময়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন। শিক্ষিত সমাজে এসব মানুষের মূল্যায়ন হয় না। অথচ তাঁদের কাছ থেকে উপকার নিয়েই আমরা বেঁচে থাকি। একজন মুচি যদি জুতো তৈরি বা সেলাই না করতেন তবে আমাদের খালি পায়ে পথ চলতে হতো। এ রকম অনেক পেশার মানুষ আছে যারা অন্যের উপকারে ন্যুনতম মূল্যে বিক্রি করছেন তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ শ্রম।
নেত্রকোনা সদরের ইসলামপুর রোড এর এক পাশে রাস্তার উপরে ছোট্ট একটি দোকান। দোকান বলতে পায়ে চলা রাস্তার পাশে ড্রেনের উপরে একটি চৌকি বিছানো। চারদিক খোলা, উপরে দুটো টিন দিয়ে চাল। সেই দোকানে বসে আপন মনে জুতো সেলাই করছেন একজন প্রবীণ ব্যক্তি। বয়সের ভারে ন্যুজ্ব হয়ে যাওয়া ব্যক্তিটির নাম অঙ্কু ঋষি। মালনীর ঋষি পাড়ায় তিনি থাকেন। এক ছেলে, এক মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে তাঁর সংসার।
আলাপচারিতার শুরুতে যখন জানতে চাইলাম ছেলে মেয়ে কয়জন, তখন খুব জোড়ে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছাড়লেন। বললেন, “ছেলে মেয়ের কথা আর জিগাইয়োনা।” ভাবলাম সন্তানেরা হয়তো তাঁকে খুব কষ্ট দিয়েছে, এখনকার সময়ে যা হয় আর কি! আবার জিজ্ঞেস করলাম, কেন কাকা কি হয়েছে? কি করেছে আপনার ছেলে মেয়েরা? এরপর তিনি যা বললেন তাতে উনাকে সান্ত¡না দেওয়ার কোনো ভাষা আমি খুঁজে পেলাম না।
অঙ্কু ঋষির ছেলে ছিল দু’টি। তার মধ্যে বড় ছেলেটির দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। যে মৃত্যু তাঁর পুরো পরিবারটিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। ছেলেটি খুব ভালো ছাত্র ছিল। যে বছর মারা যায় সে বছর এসএসসি পরীক্ষাতে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল। সে বছরই সেনাবাহিনীর সৈনিক পদে যোগ দেওয়ার কথা ছিলো। ট্রেনিং এ চলে যাবার আগে বাড়ির বৈদ্যুতিক লাইনগুলো মেরামত করতে চেয়েছিল। কিন্তু একটি তার ছিঁড়ে পুকুরের পানিতে পড়েছিল, সেটা কেউ জানতোনা। সেই তার জড়িয়ে ছেলেটি মারা যায়। এই ছেলেটির মর্মান্তিক মৃত্যু পরিবারসহ সমস্ত এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলো। প্রায় দু বছর অতিবাহিত হয়েছে, তবু পরিবারটি এখনো সেই শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি। ছেলে হারানোর শোকে অঙ্কু ঋষি এখনো স্তব্ধ হয়ে যান। কথা বলতে বলতে নিজের অলখেই চোখের কোণে অশ্রু জমা হয়। তাঁর জীবনের চাকা যেন থেমে যায়।
কত বিচিত্র মানুষের জীবন, কত রঙ বেরঙের কষ্ট। অঙ্কু ঋষি পেশায় একজন মুচি। তিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর যাবৎ এই কাজ করে যাচ্ছেন। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। বাবার রেখে যাওয়া সম্পত্তির মধ্যে তিনি ভাগে যতটুকু পেয়েছেন, সেখানেই ঘর তুলে স্ত্রী সন্তানসহ থাকেন। তাঁর বয়স প্রায় সত্তুর এর কাছাকাছি। তিনি বলেন, “পাকিস্তান আমলে আমি ক্লাস ফাইভ পাশ করছি, আর বেশি পড়ি নাই। পড়লে তোমরার মতো কলম চালাইতে পারতাম। আইজ মাইনষের জুতা বান্ধন লাগেনা।”
প্রতিদিন তিনি রাস্তার একচালা দোকানে বসে জুতো সেলাই করেন। এই কাজ করে দৈনিক প্রায় ২০০/৩০০ টাকা রোজগার করেন। কোনো দিনও বা এর চেয়ে কম। এই সামান্য উপার্জনে তাঁর সংসার কোনো রকমে চলছে। যেদিন তাঁর শরীর বা মন সায় দেয়না সেদিন কাজে আসেন না। সংসারও অচল থাকে।
জুতো সেলাই বা মেরামত করতে কিছু উপাদানের প্রয়োজন হয়। যেমন, কাঁচি, বাঁটাল, চিমটা, সূতা, হাতুড়ি, চামড়া, আঠা ইত্যাদি। এক বা-িল প্লাস্টিকের সূতা কিনতে ত্রিশ টাকা লাগে। এই সূতা দিয়ে তিনি প্রায় এক সপ্তাহ জুতো সেলাইয়ের কাজ করতে পারেন। বড় মাপের এক জোড়া জুতো সেলাই করতে ত্রিশ টাকা আর ছোটদের জুতো বিশ টাকা লাগে। জুতোর চামড়া উঠে গেলে আঠা লাগিয়ে দেন। আবার মুছে পরিষ্কার করে রঙ করে দেন। এর জন্য বাড়তি কোনো টাকা দিতে হয় না। নিজের জুতো মেরামতের সরঞ্জামগুলো একটি কাঠের বক্সে ভরে সকালে নিয়ে আসেন, আবার বিকেলে বাড়িতে নিয়ে যান।
প্রতিদিন ক’জোড়া জুতো সেলাই করেন তা সঠিক হিসেব নেই। কারণ তিনি যেখানে বসে কাজ করেন সেই রাস্তায় অনেক মানুষের আনাগোনা। আছে মোহনগঞ্জ যাবার সিএনজি স্ট্যান্ড। চারদিক দিয়ে শহর ও শহরের বাইরে যাবার রাস্তা চলে গেছে। পথে যদি কারো জুতো ছিঁড়ে যায় তখন তারা আসে। আবার ইসলামপুর ও মালনীতে অনেক মানুষের বসবাস। তারাও প্রতিদিনই আসেন জুতো সারিয়ে নিতে।
কয়েক বছর আগেও তিনি জুতো সেলাই করে সময় পেতেন না। কোনো কোনো দিন দুপুরে খাবার খাওয়ার সময়ও হতোনা। কারণ তখন প্লাস্টিক জুতোর প্রচলন ছিল না। সবাই নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি বা কম দামের চামড়ার জুতোই কিনতো। একটু ছিঁড়ে গেলে সেলাই করে নিতো। বর্তমানে বেশির ভাগ নিম্ন শ্রেণির মানুষ প্লাস্টিক এর জুতো পড়ে। এই জুতো একটু কম দামে পাওয়া আবার ছিঁড়ে গেলে নতুন জুতো কিনে নেওয়া যায়।
একচালার দোকানটিতে বসে সারাদিন তিনি আপন মনে কাজ করেন। কোনো সময় পথচারীরা তাঁর চৌকিতে বসে একটু জিরিয়ে নেয়। তখন তাদের সাথে কথা বলে সময় কাটানো যায়। যে ঘরে বসে তিনি কাজ করেন এই ঘরের জন্য কাউকে ভাড়া দিতে হয়না। দখল সূত্রে তিনিই এর মালিক।
ঋষি সম্প্রদায়ের আদি পেশা হলো চামড়া বিক্রি ও জুতো সেলাই। কিন্তু এ পেশায় এখন মুসলিম বা অন্য সম্প্রদায়ের লোকেরাও যুক্ত হয়েছেন। রাস্তার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে ভ্রাম্যমান বা অস্থায়ী মুচির দোকান। যে কারণে এই সম্প্রদায়ের অনেকেই এখন নিজ পেশা থেকে বিচ্যুত হয়ে অন্য পেশার দিকে ঝুঁকছেন। তবুও অঙ্কু ঋষিদের বাঁচার একমাত্র অবলম্বন জুতো সেলাই।