মশাল: পারিবারিক জ্বালানির অন্যতম উৎস
সাতক্ষীরা থেকে এস, এম নাহিদ হাসান:
গ্রামটির নাম কলিয়া। এটি তালা উপজেলার ৫ নং তেঁতুলিয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। তালা উপজেলার যে সমস্ত গ্রামগুলো বর্ষাকালে ৪ থেকে ৫ মাস জলাবদ্ধ থাকে এটি তার মধ্যে অন্যতম। জলাবদ্ধতা একটি গ্রাম বা পরবিারের জন্য অবর্ণনীয় ভোগান্তি। আর সেই ভোগান্তি চরমভাবে উপলব্ধি করে পরিবারের নারী সদস্যরা। তাদের নানাবিধ ভোগান্তির মধ্যে অন্যতম একটি হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের জন্য ৩ বেলা রান্না করা। কেননা, জলাবদ্ধতার ফলে পারিবারিক জ্বালানি সংকট তীব্র হয়ে ওঠে। কিন্তু এই গ্রামের নারীরা জলাবদ্ধতায় জ্বালানি সংকটকে জয় করেছে তাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে বহমান ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান আর চর্চা দিয়ে। এই জলাবদ্ধতাকে জয় করে তাদের জীবন যাপন অতিবাহিত করছে।
এখানকার নারীরা প্রায় প্রতিদিনই একটি কাজ নিয়মিত ভাবে করে। প্রতিদিন সকালে কিছু পাটখড়ি, পানি আর গরুর বিষ্ঠা (স্থানীয় ভাষায় গোবর) দিয়ে মশাল বানাতে দেখা যায়। স্থানীয়রা এই মশাল কে নুড়ি বা বড়ি বলে থাকে। আবার এই গরুর গোবর দিয়ে চাপটা তৈরি করে বাড়ির দেয়াল, গাছ, বাড়ির প্রাচিরে দিতে দেখা যায়। এই জলাবদ্ধ এলাকার গ্রামীণ নারীদের রান্নার প্রধান জ্বালানী হিসাবে এই মশাল ব্যবহার করা হয়। এটি এই এলাকায় বেশ জনপ্রিয়ও।
মশাল তৈরিকারী রমেছা বেগম বলেন, “গ্রামে যখন পানি ওঠে তখন আমরা রান্না করার জন্য কোন কাঠ পাই না। তাই সারা বছর মশাল বানিয়ে তা দিয়ে রান্না করি আর রেখে দি; পানির সময় মশাল ব্যবহার করি। আর অতিরিক্ত মশাল বিক্রি করি। এক হাজার মশাল ১১০০- ১২০০ টাকা বিক্রি করি।” গ্রামের বিভিন্ন বাড়ি ঘুরে দেখা যায় বাড়ির আঙিনায় তৈরি করা মশালগুলো রোদে শুকানোর জন্য রাখা হয়েছে। বিভিন্ন বাড়িতে মাচা করে মশার সংরক্ষণ করতেও দেখা যায়।
গৃহিণী তহমেনা বেগম বলেন, “তাদের মশাল তৈরি করতে আলাদা কোন অর্থ খরচ হয় না। নিজেদের বাড়ির গরুর গোবর দিয়েই যে মশাল তৈরি হয়- তা সারা বছর রান্না করেও বাকিটা বিক্রি করতে পারি। আশেপাশের গ্রাম থেকেও আমাদের কাছে মশাল কিনতে লোক আসে।” তিনি আরো বলেন, “মশাল তৈরি করার পর ভাল রোদে পেলে শুকাতে ৩-৪ দিন সময় লাগে তারপর মাচান করে কয়েকবছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।”
কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের গ্রাম বছরে ৪-৫ মাস পানির নিচে থাকে। তাই মহিলারা বড়ি তৈরি করে রাখে পানির সময় এই দিয়ে রান্না করে। বাড়ির মহিলারা বড়ি বিক্রি করে নিজেদের হাত খরচের টাকা বের করে।”
জলাবদ্ধতায় জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় কালিয়া গ্রামের নারীরা ব্যবহার করেছে গ্রামীণ কৃষক পরিবারের ঐতিহ্যবাহী জ্ঞান। যা তাদের সমসায়িক সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রেখেছে। গ্রামীণ পরিবারের পারিবারিক জ্বালানি নিয়ে হয়তো ভাবনা নেই অধিকাংশ মানুষের। কিন্তু প্রতিটি জ্বালানির ধরণ, সংগ্রহ এবং ব্যবহারে রয়েছে নারীর নিজস্ব জ্ঞান আর উদ্ভাবনী শক্তি।