করমজা বরেন্দ্র এলাকার ঔষধি বৃক্ষ
:: রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
এটি বাংলাদেশের পরিচিত ফল করমচা নয়,বরেন্দ্র অঞ্চলের রাজশাহীর একটি ঔষধি গাছ যার রয়েছে বিভিন্ন গুন। আমরা রাজশাহীর একটি পরিচিত বৃক্ষ করমজার কথা বলছি । এই বৃক্ষের ঔষধি গুণের কারণে মানুষের মাঝে বেশ প্রিয়। এই এলাকার প্রায় প্রতিটা গ্রামেই করমজা গাছ দেখতে পাওয়া যায় । এই গাছ অ্ন্যান্য কাঠ জাতীয় গাচের মতই বড় ও মোটা হয়। এই গাচের কাঠ খুব শক্ত হওয়ার কারণে অন্য কাঠের তুলনায় বাজারের চাহিদা বেশি। করমজা গাছ বীজ থেকে বংশ বৃদ্ধি করে। বীজ মাটিতে রোপণের ৭-১০ দিনের মধ্যই চারা গজায়। চারা গজানোর পর তেমন কোন পরিচর্যা করতে হয় না বললেই চলে। পাতা দেখতে বেল পাতার মত,কচি পাতা কিছুটা লালচে হয়। গাছের গায়ে ও মোটা ডালে ছোপ ছোপ সাদা দাগ লক্ষ্য করা যায়। বছরে দুই বার এই গাছে ফুল ও ফল আসে। প্রথমবার আষাঢ়-শ্রাবণ মাসে এইং দ্বিতীয়বার পৌষ-মাঘ মাসে। তবে দ্বিতীয়বারেই ফল বেশি হয়। পৌষ মাসের মাঝামাঝি থেকে মাঘ মাসের মাঝামাঝি সময়ে এই গাছে কলি আসে, কলি থেকে ২-৩ দিনের মধ্যই ফুল ফোটে। ফুলগুলো দেখতে বেলি ফুলের মত তবে একটু ছোট ও সাদা হয় তবে প্রতিটি ফুলের মুখেই লাল দাগ লক্ষ করা যায়। এই লাল দাগের কারণে ফুল গুলো দেখতে খুবই আকর্ষনীয় কিন্তু এই ফুলে কোন গন্ধ হয় না। মাঘ মাসের শেষের দিক থেকে ফুল গুলো ফলে পরিণত হতে শুরু করে। করমজার ফল কাঠ বাদাম ফলের সমান লম্বা কিন্তু চ্যাপ্টা ও ফলের বোটা শক্ত হয়। একটি ফলের মধ্য ১-৩টি বীজ হয়। এ বীজ গুলো কাজু বাদামের মত।
করমজা ফল থেকে বীজ সংগ্র্হ
চৈত্র মাসের মাঝামাঝি থেকে করমজা ফলগুলো পরিপক্ক হতে শুরূ করে। চৈত্র মাসের শেষের দিক থেকে বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ফল সংগ্রহ করা হয়। ফল সংগ্রহ করে ২-৩টি রোদ দিয়ে ভালো করে শুকিয়ে নেওয়া হয়। পরে শক্ত কোন কিছুর আঘাতে ফল থেকে বীজ আলাদা করে নেওয়া হয়। ফল থেকে বীজ আলাদা করে নেওয়ার পর বীজগুলোকে পুনরায় ২-৩টি রোদ দিয়ে শুকিয়ে নেওয়া হয়। বীজ গুলো ভালো করে শুকানো হলে লাল রঙ ধারণ করে। এই লাল রঙের বীজই তেল তৈরির জন্য উপযোগী। এ কাজের সাথে সম্পৃক্ত যোগীশো গ্রামের কৃষানী মোঃ সানোয়ারা বেগম(৫৮) বলেন, “করমজার বীজগুলো যত ভালো করে শুকানো হবে তত এর গুণাগুণ ভালো হবে এবং তেলের পরিমাণও বেশি হবে।” তিনি আরও বলেন, “এক কেজি করমজা বীজ থেকে ৩০০-৪০০ গ্রাম পরিমাণে তেল বের হয়।
অন্যান্য তেল জাতীয় ফসল যেমন সরিষা, তিল, তিসি যেভাবে ভাঙানো হয় ঠিক একই প্রক্রিয়ায় করমজাও ভাঙানো হয়। তেল তৈরি করার আগে ভালো করে একটি রোদ দিয়ে ঘাঁনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। মানুষের ঘরে যখন কাঠের ঘানী দ্বারা তেল তৈরির প্রক্রিয়া চালু ছিল তখন বরেন্দ্র এলাকার প্রায় সব গ্রামেই কাঠের ঘানী থেকেই এই করমজার তেল তৈরি করা হত। বর্তমানে এই তেলের ব্যবহার কমে যাওয়া ও পশুচিালিত কাঠের ঘানী কমে যাওয়ার কারণে করমজা তেল তৈরির স্থানও কমতে শুরূ করেছে। তবে এ এলাকার মন্ডুমালা, তালন্দ, মোহনপুর, কেশরহাট বাগবাজার এলাকায় মেশিন চালিত ঘানিতে করমজার তেল ভাঙানো হয়। করমজার তেল মানুষ ও গবাদি পশুর বিভিন্ন রোগে এরং এর খৈল ফসল চাষে সমান উপকারী।
বর্তমানে গ্রামগুলোতে কৃষক-কৃষাণীরা এই করমজার তেলের সাথে সরিষা ও সয়াবিন তেলের বিনিময় প্রথা চালু করেছেন। এখন এক কেজি করমজার তেল দিয়ে সমান এক কেজি সরিষা বা সয়াবিন তেল পাওয়া যায়্। গ্রামের কৃষাণীদের সাথে আলোচনা করে জানা যায়, করমজা তেল শুধুমাত্র ঔষধ হিসাবে ব্যবহার হওয়ার কারণে বিনিময় প্রথা চালু হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কৃঞ্চপুর গ্রামের কৃষক আনছার অলী বলেন, “কিছু ফেরিওয়ালা গ্রামে গিয়ে বাড়ি বাড়ি থেকে সরিষার তেলের বিনিময়ে করমজার তেল নিয়ে যায় বা ২০-২৫ টাকা কেজি দরে করমজার বীজ নিয়ে যায়।” এ বিষয়ে বাগবাজার, মোহনপুর গ্রামের ফেরিওয়ালা মো. গোলাম (যিনি ১৮ বছর এ কাজের সাথে জরিত) বলেন, “করমজার বীজগুলো এই এলাকার সব হাটে, বাজারে বিক্রয় হয় না; তবে সাবান কোম্পানিতে করমজা বীজের চাহিদা থাকার কারণে এই বীজগুলো গ্রাম থেকে সংগ্রহ করে রাজশাহীর কেশর হাটে ৪৫-৪০ টাকা দরে বিক্রয় করি।”
বিভিন্ন রোগে করমজা তেলের ব্যবহার
মানুষ ও গবাদি পশুর বিভিন্ন রোগে করমজার তেলের ব্যবহার রয়েছে। আজ থেকে ৩০-৩৫ বছর আগে মানুষের বিভিন্ন চর্মরোগ যেমন- ঘাঁ, পঁচানী, দাঁউদ, চুলকানী রোগের একমাত্র ঔষধ ছিল এই করমজার তেল। তারা জানান যে, চর্মরোগ নিরাময়ে এ কমরজা তেলের ব্যবহার করতো মানুষ; যদিও দিনে দিনে এর ব্যবহার কমে গেছে। অন্যদিকে গবাদি পশুর বিভিন্ন রোগ যেমন ঘা, ঘাড়ে কচরা (গাড়ি টানার ফলে গরু ও মহিষ ঘাড়ে কালো ও শক্ত যেটা লক্ষ্য করা যায়) ও গবাদি পশুর শরীর খসখসে হলে এই তেল ব্যবহার করা যায় বলে কৃষকরা জানান।
ফসল চাষে করমজার খৈলের ব্যবহার
করমজার খৈল উৎকৃষ্ট মানের জৈবসার। সব ধরনের মাঠ ও উদ্যান ফসলে এই খৈল ব্যবহার করা যায়। তবে পেঁয়াজ ও রসুনে এই খৈল খুব ভালো কাজ করে বলে স্থানীয় কৃষকরা জানান। করমজা ও নিমের খৈল একসাথে মিশিয়ে জমিতে ব্যবহার করলে ফসলে ক্ষতিকর পোকা-মাকড়ের আক্রমণ কম হয়। তবে যে জমিতে চেঁচুর (স্থানীয় আগাছ) জন্মায় সেখানে যদি এই খৈল ব্যবহার করা হয় তবে চেঁচুর জন্মাতে পারে না।
শেষ কথা
বর্তমানে মানুষ ও গবাদি পশুর রোগ যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে তার থেকেও অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে বিভিন্ন ঔষধ। আর এই বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির প্রচার প্রচারণার ভিড়ে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশীয় ও লোকায়ত পদ্ধতিতে তৈরি রোগের চিকিৎসার বিভিন্ন উপকরণ ও ব্যবহার। তবে আশার কথা এই যে, কিছু কিছু মানুষ তাঁদের কাজের মাধ্যমে টিকিয়ে রেখেছে এই অমূল্য জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাগুলোকে।