প্রবীণরা একটি সমাজের বাতিঘর

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

স্বাস্থ্যই সকল সুখের মূল- কিন্তু আমাদের পরিবারে, সমাজে প্রবীণ ব্যক্তিদের যেহেতু স্বাভাবিক জীবনযাপনের জন্য কষ্ট করতে হয়ে সেখানে তাঁদের নিরোগ রাখা বা স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজ খবর নেয়ার কেউ নেই। লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রাম পর্যায়ে কাজের সুবাদে প্রবীণ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সমস্যা সম্পর্কে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। পরিবার পর্যায়ে তাঁদের অবহেলা ছাড়াও সামাজিকভাবে তাঁরা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হচ্ছেন। অনেক পরিবারের প্রবীণ সদস্যগণ ঠিক মতো খাবারও পান না। পরিবার থেকে বিতাড়িত হয়ে আশ্রয় নিতে হয় অন্যের বাড়িতে। সেখানে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে আরো অসুস্থ হয়ে পড়ে। পুষ্টিকর খাবারের নিশ্চয়তাও সেখানে নেই।

IMG_20181025_113840
প্রবীণ অবস্থায় এসে একজন মানষের স্বাস্থ্যগত বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। যেমন পেশি দূর্বল হয়ে যায়, হাঁড়ের ক্ষয় হয়, লিভার ও কিডনির সমস্যা দেখা দেয়, খাবারের রুচি কমে যায়, স্মৃতিশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি কমে যায়। এহেন সমস্যায় যদি একজন মানুষকে দিনের পর দিন পুষ্টিকর খাবার না খেয়ে থাকতে হয় তাহলে তাঁদের শরীরের প্রায় সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গে রোগ ব্যধি আক্রমণ করে। এ সমস্ত কারণে আমাদের দেশে প্রবীণ ব্যক্তির সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
আবার একটি গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশের শতকরা প্রায় ৯০ জন প্রবীণ ব্যক্তি শারিরীক নির্যাতনের শিকার হন। যে মানুষগুলো তাঁদের অভিজ্ঞতার আলোকে সমাজের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে মর্যাদা পেতে পারতো, তাঁরাই আজকের দিনে সবচে’ বেশি অবহেলার শিকার হচ্ছেন।

গ্রাম পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এমনো দেখা গেছে যে, কোনো কোনো পরিবারে গৃহপালিত প্রাণিদের জন্য যে পরিমাণ খাবার বরাদ্দ থাকে একজন প্রবীণ সদস্য’র জন্য তার কণামাত্র থাকেনা। এ ধরণের পরিস্থিতির জন্য আবার বিভিন্ন কারণও খুঁজে পাওয়া গেছে। তা হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি, দারিদ্রতা, পরিবারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তির অভাব, পারিবারিক কাঠামো পরিবর্তন, সরকারি/বেসরকারি পর্যায়ে জনকল্যাণমূলক সেবার অপর্যাপ্ততা ইত্যাদি।

IMG_20181025_114838
কিন্তু বারসিক যেখানে সমাজের সকলকে সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন শ্রেণি, পেশা বা বয়সের মানুষকে সম্মানের দৃষ্টিতে দেখার মানসিকতায় কাজ করে যাচ্ছে সেখানে প্রবীণদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে গত ২৫ অক্টোবর লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদে প্রবীণ ব্যক্তিদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্বাস্থ্য ক্যাম্প এর আয়োজন করা হয়। এই ক্যাম্প পরিচালনায় সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসে নেত্রকোনা জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘ-নেত্রকোনা। এই স্বাস্থ্য ক্যাম্প এ লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের ১২টি গ্রামের প্রায় দুই শতাধিক রোগী চিকিৎসা সেবা পেয়েছেন। এখানে ব্লাড প্রেশার, ওজন ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা এবং একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সহায়তায় প্রেসক্রিপশন তৈরি করে দেয়া হয়। তাছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য প্রত্যেক রোগীর মাঝে বিভিন্ন ঔষধ বিনামূল্যে বিতরণ করা হয়েছে।

সকাল থেকেই দলে দলে প্রবীণ নারী পুরুষ এসে ভিড় জমায় পরিষদ প্রাঙ্গণে। প্রথমে চলে তাঁদের নাম রেজিষ্ট্রেশন। এর পর সূর্যের হাসি ক্লিনিক এর দুজন ল্যাব টেকনেশিয়ান ও প্যারামেডিক্স একে একে সকলের প্রেশার, ওজন ও ডায়াবেটিস পরীক্ষা করেন। এরপর আবার চলে ডাক্তার দেখানোর পালা। প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী লক্ষ্মীগঞ্জ বাজারের দুজন ঔষধ বিক্রেতা রোগীদের মাঝে ঔষধ বিতরণ করেন।

IMG_20181025_133312
এই আয়োজন উদ্বোধন করেন নেত্রকোনা জেলার পুলিশ সুপার জয়দেব চৌধুরী। এখানে আরো উপস্থিত ছিলেন নেত্রকোনার সমাজ সেবা অফিস এর পরিচালক, নেত্রকোনা চেম্বার অব কমার্স এর সভা প্রধান মো. ওয়াহেদুর রহমান, লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের প্রাক্তন চেয়ারম্যান মো. শাজাহান খান, আতকাপাড়া গ্রামের প্রবীণ মুক্তিযোদ্ধা এনামুল হক, নেত্রকোনা জেলা প্রবীণ হিতৈষী সংঘের সাধারণ সম্পাদক মো. সায়েদুর রহমানসহ ইউনিয়ন পরিষদের সচিব ও ইউপি সদস্যগণ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুলিশ সুপার বলেন, “প্রবীণ ব্যক্তিরাই আমাদের সম্পদ। তাঁদের কাছে আমাদের ঋণের শেষ নেই। কারণ তাঁদের অভিজ্ঞতার সঞ্চয় নিয়ে আমরা পথ চলি। একজন প্রবীণ শুধু পরিবার নয়, একটি সমাজের বাতিঘর। এ ধরণের অনুষ্ঠান আরো বেশি করে আয়োজন করলে প্রবীণ ব্যক্তিগণ উপকৃত হবেন। তাঁদেরকে যদি আমরা সামান্যতম সহযোগিতা করতে পারি তবে আমাদের ঋণ কিছুটা লাঘব হবে।” এরপর তিনি একজন প্রবীণ নারীর হাতে ঔষধ তুলে দিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

ময়মনসিংহ জেলার প্রাক্তন সিভিল সার্জন স্বপন কুমার সরকার রোগীদের সমস্যার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং সেই অনুযায়ী প্রেসক্রিপশন তৈরি করেন। আগত সকল অতিথিদের আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান এস.এম শফিকুল কাদের সুজা। এই স্বাস্থ্য ক্যাম্প পরিচালনার কাজে সার্বিক সহযোগিতা করে স্থানীয় যুব সংগঠন বন্ধু মহলের সদস্যগণ। তারা বিভিন্ন গ্রামের প্রবীণ ব্যক্তিদের তালিকা তৈরী, রোগীদের রেজিষ্ট্রেশন, আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণসহ রোগীদের বিভিন্ন সমস্যায় সাহায্য করেন।

সকলের সম্পৃক্ততায় সামাজিকভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সেবার অধিকার আদায়ের এ ধরণের প্রথম উদ্যোগ লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের সকল মানুষের মাঝে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এবং জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধকরণের সাথে সাথে সামাজিক সংবেদনশীলতা তৈরি করেছে।

happy wheels 2

Comments