করোনাকালীন পুষ্টির চাহিদা পূরণে কৃষাণী জাহানারা আক্তার’র উদ্যোগ

নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
বাংলার গ্রামীণ নারীরা আপন মমতায় ও অতীব যতেœ টিকিয়ে রেখেছেন স্থানীয় জাতের শস্য ফসলের বৈচিত্র্য। শাকসবজি ও নানান জাতের বীজের সমাহার টিকিয়ে রাখায় যুগ যুগ ধরে নারীরাই বংশ পরম্পরায় অবদান রেখে আসছেন। নারীরাই গ্রামীণ জীবনে জিইয়ে রেখেছেন বীজ বিনিময়ের সংস্কৃতি, বিষমুক্ত খাবার সরবরাহের পাশাপাশি সচল রেখেছেন দারিদ্রতার সাতকাহনে ঢাকা জীবনের চাকাকে। ভাটি বাংলার একটি ছোট জেলা নেত্রকোনা। প্রকৃতি তার অকৃপণ হাতে এই ভাটি অঞ্চলে তৈরি করে দিয়েছে কৃষিবান্ধব এক মনোরম পরিবেশ। তাই প্রকৃতিগতভাবে কৃষির জন্য সমৃদ্ধ নেত্রকোনা অঞ্চল। ছোট এই জেলাতে দেখা যায় বৈচিত্র্যময় ফসলের মহা সমাহার। উন্নত কৃষির নামে আমাদের গ্রামীণ নারীদের আপন জ্ঞান অভিজ্ঞতায় গড়া স্বনির্ভর, পরিববেশবান্ধব, কৃষক নিয়ন্ত্রিত কৃষিকে করে তোলা হয়েছে রাসায়নিক উপকরণ (সার ও বিষ) নির্ভর বাণিজ্যিক কৃষিতে। যেখানে নারীদের দীর্ঘ দিনের জ্ঞান অভিজ্ঞতাকে করে তোলা হয়েছে মূল্যহীন, প্রকৃতিকে করে তোলা হয়েছে বিপন্ন। এত বিপন্নতা আর বিনাশের কালে এখনও নেত্রকোনা অঞ্চলের গ্রামীণ নারীরা বৈচিত্র্যময় শস্য ফসল চাষে পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ গ্রহণ করে স্বনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা সচল রাখাসহ প্রাণবৈচিত্র্যকে সংরক্ষণের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।


নেত্রকোনা জেলার কাইলাটি ইউনিয়নে এমনি একজন উদ্যোগি নারী জাহানরা আক্তার। বাড়িভিটাসহ মাত্র ৫০ শতাংশ জমি জাহানারা আক্তার’র। এই সামান্য বসতভিটার জমির সুষ্ঠু ব্যবহার করে পরিবারের পুষ্টির চাহিদা মিটিয়েও বাজারে বিক্রি করে এবং ভালো মানের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণ করে অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি তথা পরিবারের আত্মনির্ভরশীলতা অর্জনই জাহানারা আক্তার’র দর্শন। কোন কিছুর জন্য পরনির্ভর বা কোম্পানির উপর নির্ভর হতে না হয় সেই উদ্দেশ্যেই গ্রামের কৃষকদের সবজি চাষ ও বীজ সংরক্ষণে উৎসাহিত করেন জাহানারা আক্তার। তিনি বসতভিটায় বছরব্যাপী ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, করলা, আলু, পুঁইশাক, ডাটা, মূলা, টমেটো, ঢেড়স, বেগুন, বরবটি, সীম, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, শশা, পেঁপে, চুকাই ইত্যাদি সবজির পাশাপাশি মরিচ, ধনিয়া, হলুদ, গুয়ামুড়ি ও আদাসহ নানান প্রকার মসলার চাষ করে থাকেন। শুধু সবজি ও মসলার চাষই করেন না এসব সবজি ও মসলা ফসলের বীজও তিনি নিজেই সংরক্ষণ করেন। তিনি গ্রামের কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে বিনামূল্যে বীজ বিতরণ করতে এবং সকলকে নিজেদের চাষকৃত সবজি ও অন্যান্য ফসলের বীজ সংরক্ষণে গ্রাম পর্যায়ে বীজ মেলা ও বীজ বিনিময় অনুষ্ঠান আয়োজন করেন। সবজি চাষ, সবজি বিক্রি, বীজ সংরক্ষণ ও নিয়মিত পারস্পারিক বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে কৃষি উপকরণ তথা বীজের সহজলভ্যতা সৃষ্টির জন্য তিনি গ্রামের অন্যান্য কৃষক-কৃষাণীদেরকে সংগঠিত করে মৌজেবালি গ্রামে গড়ে তুলেছেন ‘রাখাল বন্ধু কৃষক সংগঠন’।


সংগঠনের সভায় কৃষাণী জাহানারা আক্তার সদস্যদেরকে বছরব্যাপী সবজি চাষ করতে এবং স্থানীয় জাতের বীজ উৎপাদন ও সংরক্ষণের পরামর্শ দেন। কৃষাণী জাহানার আক্তার’র মতে, ‘রাসায়নিক সার পরিমিত ব্যবহার করে পর্যাপ্ত জৈব সার ব্যবহার এবং রাসায়নিক কীটনাশকের পরিবর্তে ভেষজ কীটনাশক ব্যবহার করে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন সম্ভব। বৈশ্বিক মহামারী করোনাকালীন মহাসংকটে নিরাপদ ও পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার জরুরি বলে টেলিভিশনের খবর ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জেনেছি। তাই আমি বিভিন্ন ধরণের সবজি ও ফল বছরব্যাপী চাষ করে পরিবারের সকলে খেয়েও এলাকার ভোক্তাদের পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির চাহিদা পূরণের মাধ্যমে করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে সহযোগিতা করার চেষ্ট করছি। বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ বৃদ্ধি করে বিষমুক্ত নিরাপদ সবজি সকলের জন্য সহজলভ্য করতে পারলে তাহলেই আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং মহামারী করোনা ভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে।’

করোনা দূর্যোগকালীন সময়ে গ্রামের প্রত্যেক পরিবারকে বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজির চাষে উদ্বুদ্ধকরণের অংশ হিসেবে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ বৃদ্ধির লক্ষ্যে কৃষাণী জাহানারা আক্তার এপ্রিল ২০২১ মাসে নিজের সংরক্ষিত বীজ থেকে স্থানীয় ১০ জাতের সবজি বীজ (চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, ঝিঙ্গা, চিচিঙ্গা, শসা, পেঁপে, করলা, ডাটা, পুইশাক, করলা) নিজ গ্রামের ৫০ জন কৃষক-কৃষাণী ও সংগঠনের সদস্যদের মধ্যে বিতরণ করেছেন। তিনি প্রত্যেক সদস্যদেরকে নিজ নিজ বসতভিটায় বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করেও উদ্বৃত্ত্ব সবজি বাজারে বিক্রি করে পারিবারিক আয় বৃদ্ধির পরামর্শ দেন। কৃষাণী জাহানারা আক্তার বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস এর সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকতে জরুরি প্রয়োজনে ঘরের বাইরে গেলে সকলকে সঠিক নিয়মে মাস্ক ব্যবহার করে নিরাপদ দূরুত্ব বজায় রেখে চলতে এবং প্রচুর পরিমাণে টাটকা শ্কা সবজি খাওয়ার পরামর্শ দেন।

happy wheels 2

Comments