তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে

তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়

“পানি নিয়ে ভাবনা আর না আর না, পেডরোলো পাম্প আছে আর নেই ভাবনা”। আমাদের প্রচার মাধ্যমের এক সময়ের জনপ্রিয় একটি সাবমার্সিবল পাম্প এর বিজ্ঞাপন ছিল এটি। সত্যিই তো পাম্প এর সুইচ টিপে কত সহজেই পানির ট্যাংক ভরে নেওয়া যায়। শহরে বসবাসকারী বিত্তশালী মানুষেরা নিজেদের বাড়িতে পানির জন্য কত দামী পাম্প ব্যবহার করেন। সেই পাম্পের পানির সাহায্যে নিত্য নৈমিত্তিক কাজ সারতে পারেন। কাপড় কাঁচা, ঘর মোছা, বাসন ধোয়া, গোসলসহ সব কাজ করেন। রান্না ঘরে পানির কল, বাথরুমে কল, খাবার ঘর এমনকি বারান্দাতেও হাত-মুখ ধোয়ার জন্য পানির আলাদা ব্যবস্থা থাকে। অনেক শৌখিন শ্রেণির পরিবারে গাছের যত্ন নেওয়ার জন্য বাগান বা ছাদে পানি তোলার বিশেষ ব্যবস্থাও থাকে। সারাদিন ধরে তারা কত কত লিটার পানি ব্যবহার করছেন এবং এর জন্য মাসিক কত টাকা বিদ্যুৎ বিল বহন করছেন তার হিসাব রাখার প্রয়োজন হয়না। কারণ তাদের টাকার অভাব নেই।

IMG_20180208_123937
মানুষের এই যথেচ্ছা পানি ব্যবহারের ফলে ভূগর্ভের সঞ্চিত পানি ক্রমশঃ ফুরিয়ে আসছে। এর অনেক উদাহরণ আমরা চোখের সামনে প্রতিনিয়তই দেখতে পাই। কারণ শুষ্ক মৌসুমে আমাদের পুকুর, ডোবানালা, বিভিন্ন জলাশয় এমনকি নদীগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যায় পানির অভাব কতটা চরম সীমায় পৌঁছেছে। সারাদিন বিভিন্ন কাজে আমাদের পানির প্রয়োজন হয়। ঘুম থেকে উঠার পর হতে শুরু করে ঘুমুতে যাওয়ার আগে পর্যন্ত পানি ব্যবহার করে অনেক কাজ করি। আমরা টাকা পয়সা হয়তো হিসেব করে খরচ করি। কারণ বে-হিসেবি খরচ করলে সঞ্চয়ে টান পড়তে পারে। এটা সবাই বুঝি। কিন্তু পানি খরচের বেলায় হিসেব বুঝিনা।

পানির অভাব শহর ও গ্রাম উভয় জায়গাতেই দেখা যায়। তবে গ্রামের চাইতে শহরে কিছুটা বেশি। এর কারণ হচ্ছে গ্রামে প্রায় প্রত্যেক পরিবারে ব্যক্তি মালিকানাধীন পানির উৎস অর্থাৎ পুকুর আছে। শুধুমাত্র খাবার পানি বাদে অন্যান্য সকল প্রয়োজন মেটানো যায় পুকুরের পানি ব্যবহার করে। কিন্তু এই সুবিধা শহরে নেই। ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর তো দূরে থাক, সংখ্যাতেও কম। যাও আছে তা কোনো প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর দখলে। তবে ব্যবহারের জন্য অনেক ক্ষেত্রে বিধি নিষেধ থাকলেও প্রয়োজন মাফিক ব্যবহার যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। নেত্রকোনা শহরের বড় পুকুর ও উপজেলা পরিষদ প্রাঙ্গণের পুকুরে প্রতিদিন শত শত নারী পুরুষ গোসলসহ অনেক কাজ করেন।

গ্রামাঞ্চলের মানুষ অনেক বেশি মানবিক, তাঁরা একে অপরের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ান। নির্দ্ধিধায় নিজের পুকুরের পানি অন্যদের ব্যবহার করতে দেন। শহরের মানুষেরা টাকার বিনিময়ে পানি ব্যবহার করেন। আবার তারা নিজস্ব গণ্ডির ভিতরেরই সীমাবদ্ধ থাকে। যে কারণে সামাজিকতা বা মানবিকতার বিষয়টিকে এতো প্রাধান্য দেয়না। তাই কার পানির প্রয়োজন বা কে সমস্যায় আছে সেটিও এত গুরুত্বপূর্ণ নয় তাদের কাছে।

IMG_20180222_120740 (1)
একদিকে পানির সংকট অন্যদিকে বিশুদ্ধ পানির অভাব। নেত্রকোনা শহরের মগড়া নদীর তীরবর্তী দরিদ্র শ্রেণির জনগণ শুষ্ক মৌসুমে এই সমস্যায় ভোগেন। বিশেষ করে পশ্চিম কাটলী, সাতপাই, মালনী রোড, শিবগঞ্জ রোড, আরামবাগ প্রভৃতি এলাকা। মগড়া নদীর তীর ঘেঁষে সমস্ত শহরের ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে প্রতিনিয়ত নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। এই পানির উপর যে সমস্ত পরিবার নির্ভরশীল তাঁদের তখন সমস্যার অন্ত নেই। অনেকটা বাধ্য হয়েই তাঁরা এই দূষিত পানি ব্যবহার করছেন।

পানি ব্যবহারের জন্য সবচে’ বেশি দূর্ভোগ পোহাতে হয় শহরের দরিদ্র শ্রেণির মানুষদের। এর মধ্যে নেত্রকোনা শহরের হরিজন সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ না করলেই নয়। পানির অপচয় করা তো দূরের কথা খাবার পানি সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁদের শুনতে হয় কটুক্তি। অনেক সময় তা বড় ধরনের ঝগড়াতেও পরিণত হয়। অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে অতোটা নেই। কারণ তাঁদের মধ্যে ছুঁয়া-ছুঁয়ির বিষয়টি থাকেনা। প্রতিবেশি বা ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষদের বাড়ি থেকে পানি সংগ্রহ করতে পারে। হরিজনদের বেলায় সেটি সম্ভব হয়না।

আরামবাগ এলাকার হরিজন পল্লীতে কোনো টিউবওয়েল বা সাবমার্সিবল পাম্প নেই। তাঁদের পানির একমাত্র উৎস মগড়া নদী। প্রতিদিনের পানি সংক্রান্ত যাবতীয় কাজের জন্য এই নদীর পানি ব্যবহার করেন। পল্লীর কাছাকাছি নদীর পাড়ের একটি জায়গাতে কাজ করার জন্য ঘাট বানিয়ে নিয়েছেন। সেখানে বসেই সকল নারীরা কাপড় কাঁচা, বাসন ধোয়া, গোসলসহ সকল কাজ করেন। প্রতিদিন দু’বার করে তাঁরা নদীতে যায়। সারা দিনের ব্যবহার করা থালা-বাসন ও কাপড় চোপড় একত্রিত করে দিন শেষে, আবার রাত ও সকালের খাবারের পর যে বাসনপত্র জমা হয় তা নিয়ে দুপুরে একেবারে গোসলও সেরে আসেন।

যে জায়গাটিতে বসে তারা কাজ করেন সেখানেও আছে আবর্জনার স্তুপ। পাশেই আছে একটি খাবারের হোটেল। সেখানে নালা কাটা আছে। এই নালার মাধ্যমে নোংরা পানি এসে মিশছে নদীর পানির সাথে। পাশেই হয়তো বা কোনো শিশু পায়খানা সেরে উঠে যাচ্ছে নদীর জলে ধুয়ে নিতে। অপরিষ্কার, গন্ধযুক্ত পানি দিয়েই চলে তাদের সকল কাজ।

IMG_20180222_120115
অন্যের বাড়ির সামনে পৌরসভার সরবরাহকৃত লাইন, পার্শ্ববর্তী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সদর হাসপাতাল টিউবওয়েল থেকে যে পানি সংগ্রহ করেন সেই পানি দিয়ে রান্না করা ও খাওয়ার কাজ করেন। এই পানি দিয়েই আবার নতুন মা’য়েরা তাদের সন্তানদের গোসল করিয়ে থাকেন। ১৭ বছর বয়সী ঝুমা বাঁশফোর তাঁর ছেলের ত্বকের সুস্থ্যতার জন্য বড় চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। কারণ কয়েকদিন নদীর পানি দিয়ে গোসল করানোর পর চামড়ায় কিছু ফুস্কুরি দেখা দেয়। সাথে ছিল চুলকানি। রীতিমতো ডাক্তারের ঔষধ দিয়ে ভালো করতে হয়েছে। তিনি বলেন,“নদীর জলের লেইগ্যা আমার বেটার সইল্যে (শরীরে) গোটা উঠছিলো। বেটা আমার কি কান্দন কানছে। দুইটা রাইত আমি ঘুমাইনাই। সে লিয়ে গেছি ডাক্তার মসাইয়ের কাছে। অনেক টেকার অসুধ লেইখ্যা দিছে। কিনমু কি দিয়া, টেকা তো নাই। আমি নিজে গিয়া হাসপাতালের বাথরুম পরিষ্কার করছি। তারা যে টেকা দিছে হেই দিয়া অসুধ কিইন্যা খাওয়াইছি, সইল্যেও মাখাইছি। তিনি আরও বলেন, “অহন একটু ভালার দিকে। আর নদীর জলে ছান (স্নান) করামুনা, ইস্কুলের কল থেইক্যা জল আনছি। মাইনসে যত গাইল পারে পারুক, আমি পত্যেক দিন এক বালতি জল আইন্যা আমার বেটারে ছান করাইমু। হের বাপে ভালা সাবান আইন্যা দিছে, এইডা দিয়াও ছান করাইতাছি।”

প্রত্যেক মা’ই তাঁর সন্তানের ভালো-মন্দ নিয়ে চিন্তিত থাকেন। সন্তান যে তাঁর নাড়ি ছেঁড়া ধন। সে কোনো হরিজন মাতাই হোক বা সম্ভ্রান্ত ঘরের শিক্ষিত মা। সন্তান জন্মদানের কষ্ট সবার কাছেই এক রকম। আমরা বিত্তবান, শিক্ষিত এবং সমাজের উঁচু শ্রেণির মানুষ বলে চিরকাল শুধু ভালোটাই নিতে থাকবো? তাঁদেরও তো অধিকার আছে সন্তানের জন্য ভালো কিছু চাইবার। এক শ্রেণির মানুষ ঘরে বসে সকল সুবিধা ভোগ করে অন্য শ্রেণির মানুষ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেও কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারেনা। সকল সময়ের জন্য তাঁরা সুবিধা বঞ্চিত, অবহেলিত।

ঝুমা বাঁশফোরের মতো মায়েরা বেঁচে থাকবে যতদিন, ততদিন কোনো সন্তান অসুস্থ হবেনা। তাঁরা হয়তো নদীর জল বিশুদ্ধ করতে পারবেনা কারণ সেই শক্তি-সামর্থ্য তাঁদের নেই। কিন্তু সন্তানের জন্য নির্মল স্নানের জলের পাশাপাশি তাকে সুস্থ রাখার প্রাণান্ত চেষ্টা করতে পারবেন। এই সকল মায়েদের জন্য রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়, “তুমি নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে, তব পূণ্য কিরণ দিয়ে যাক মোর, মোহ কালিমা ঘুচায়ে।”

happy wheels 2

Comments