কাবুন্দুলান’র দোলায় গাছগড়িয়ার কৃষকরা

নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং
কৃষি, আবহাওয়া ও জলবায়ু পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। কৃষি ফসলের ফলন নির্ভর করে মূলত আবহাওয়ার উপর। বর্তমান সময়ে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ও মানবসৃষ্ট কারণে লবনাক্ততা বৃদ্ধি, আগাম বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অসময়ে বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা, রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাবের ফলে কৃষি আজ হুমকির মূখে। কৃষকদের বর্তমান চাহিদা আগাম, লবণাক্ততা, পানি, খরা ও রোগ-বালাই সহনশীল ফসলের জাত (বিশেষভাবে ধান ফসলের জাত)। চাহিদানুযায়ী ধান ফসলের জাত না পাওয়ায় কৃষকরা প্রতি মৌসুমে ধান চাষ করতে গিয়ে কোননা কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ২০১৭ বোরো মৌসুমে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা আগাম বন্যায় প্রায় ৯০% ধান ঘড়ে তুলতে পারেনি। ২০১৭ আমন মৌসুম ও ২০১৮ বোরো মৌসুমে লিভ ব্লাস্ট, নেক ব্লাস্ট ও নট ব্লাস্ট, গোড়া পঁচা এবং পাতা পোড়া রোগের প্রার্দুভাবের ফলে ধানে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এর ফলে হাওরাঞ্চলের কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অধিকাংশ কৃষক ২০১৭ বোরো মৌসুমে আগাম বন্যায় ধান ঘরে তুলতে না পারায় ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

IMG_20181111_112543-W600
কৃষকরা তাদের চাহিদানুযায়ী ধানের জাত নির্বাচনের জন্য বারসিক’র সহযোগিতায় ২০০৫ সাল থেকে কৃষক নেতৃত্বে এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচনের জন্য প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনা করে আসছে। গবেষণার মাধ্যমে কৃষকরা তাদের চাহিদানুযায়ী বেশকিছু ধানের জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে, যে জাতগুলো তারা বীজ সংরক্ষণ করে নিজেদের জমিতে চাষ করে বেশ লাভবান হচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার আমতলা ইউনিয়নের গাছগড়িয়া ও বিশ্বনাথপুর গ্রামের কৃষকরা ১০ শতাংশ জমিতে ১৫টি ধানের জাত নিয়ে আমন ২০১৮ মৌসুমে প্রায়োগিক গবেষণা কার্যক্রম গ্রহণ করে। কোন ধরণের সার (রাসায়নিক ও জৈব) ও কীটনাশক ব্যবহার না করে কৃষকরা গবেষণাটি করেছে। শুধুমাত্র জমি চাষ, চারা রোপণ ও ধান কাটায় শ্রম ছাড়া কোন খরচ না করেই কৃষকরা গবেষণাটি সম্পন্ন করতে সক্ষম হয়েছে। গবেষণার জন্য জমির নাড়া ও সবুজ ঘাস পঁিচয়ে সবুজ সার তৈরি করে এবং চারা রোপণের পর পার্চিং দিয়ে পোকা দমনের ব্যবস্থা করা হয়।

IMG_20181111_112321-W600
গবেষণা প্লটের ধান পাঁকার পর গবেষণার ফলাফল অন্যান্য কৃষকদের সাথে সহভাগিতা করতে এবং লক্ষ্যিত ধানের জাত নির্বাচন করতে কৃষকরা মাঠ দিবসের আয়োজন করে। মাঠ দিবসে আশেপাশের চারটি গ্রামের প্রায় ৩০ জন কৃষক-কৃষাণী (নারী-৮) অংশগ্রহণ করেন। মাঠ দিবস উপলক্ষে গবেষণাধীন ধানের প্লট পরিদর্শন, পছন্দের ধানের জাত নির্বাচন, প্লটের ধান কাটা এবং আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। শুরুতে অংশগ্রহণকারী কৃষক-কৃষাণীদেরকে গবেষণার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবগত করেন বারসিক নেত্রকোনা প্রতিনিধি শংকর ¤্রং। তিনি কোন ধরণের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়া জমির খাদ্য জমিতে তৈরি করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে চাষাবাদ করে ভালো ফলন ও আগাম হয় এমন জাত নির্বাচনের জন্য গবেষণাটি করা হয়েছে বলে জানান। তিনি অংশগ্রহণকারী কৃষকদেরকে তাদের চাহিদানুযায়ী ধানের জাত নির্বাচনের জন্য গবেষণার মাঠ সরেজমিনে পরিদর্শনের আহবান জানান।

IMG_20181111_113211-W600
কৃষক-কৃষানীরা সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শনে নেমে প্রতি গোছায় ধানের কুশির সংখ্যা, শীষের দৈর্ঘ্য, প্রতি শীষে পুষ্ট দানার সংখ্যা, দানার ওজন ও আকার, রঙ, রোগ-বালাই সহনশীলতা, খড়ের মান, গাছের উচ্চতা (হেলে পড়েনা), কোন ধরণের সার ছাড়াই ফলে এবং আগাম পাকে ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে পছন্দের ধানের জাত নির্বাচন করেন। গবেষণা প্লট থেকে কৃষক-কৃষাণীরা ৫টি ধানের জাত এলাকার জন্য উপযোগি বলে নির্বাচন করেন। কৃষকদের নির্বাচিত জাতগুলোর মধ্যে- কাবুন্দুলান, M-394-1, DS-04, DS-, এবং JUNE-T. অংশগ্রহণকারী সকলে কাবুন্দুলান ধানের জাতটি বেশি পছন্দ করেন। নির্বাচিত সকল ধানের জাতই ফিলিপাইন এর কৃষকদের ব্রিডিংকৃত লাইনের ধান জাত। নিম্নোক্ত বৈশিষ্টের ভিত্তিতে কৃষকরা তাদের পছন্দের ধানের জাতগুলো নির্বাচন করে।

IMG_20181115_144437-W600

মাঠ পরিদর্শন করে পছন্দের জাত নির্বাচনের পর কৃষক মাঠ দিবস উপলক্ষে গবেষণা প্লটেই এক আলোচনার আয়োজন করা হয়। গবেষণায় অংশগ্রহণকারী কৃষকরা গবেষণা কার্যক্রমের পদ্ধতি এবং গবেষণার ফলাফল সকলের সাথে সহভাগিতা করেন। কৃষক আব্দুল কাদির গবেষণা কার্যক্রম সম্পর্কে বলেন, ‘কোন রকম সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে ধানের জাত গবেষণার কথা শুনে প্রথমে আমারা অবাক হয়েছি। শংকর দা’ আমাদেরকে প্রায় একমাসেরও বেশি সময় আগে জমি দুই চাষ দিয়ে জমিতে পানি ধরে রাখতে বলেন, যাতে জমিতে নাড়া পঁচে সার তৈরী হয় এবং জমিতে সবুজ ঘাস বেশি পরিমানে জম্মে। যেহেতু গবেষণা প্লটে কোন সার প্রয়োগ করা হবে না, তাই জমিতে কম্পোস্ট ও সবুজ সার তৈরি করতে হবে। চারা রোপণের জন্য জমি কাদা করতে গেলে কাদার পরিমাণ ও মান দেখেই বুঝা গেছে যে, নাড়া ও সবুজ ঘাস পঁচে জমি প্রচুর উর্বর হয়েছে। ফলে পুরো মৌসুমে কোন সার দিতে হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘চারা রোপণের পর বারসিক’র কর্মীদের পরামর্শে জমিতে ডাল পুতে দেওয়া হলে (পার্চিং) পাখি বসে পোকা-মাকড় খেয়ে ফেলায় কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়নি। শুধুমাত্র একবার আগাছা পরিষ্কার করে দিতে হয়েছে। আজ আমরা সকলের সরেজমিনে মাঠ পরিদর্শন করে এলাকা উপযোগি ৫টি জাতের ধান নির্বাচন করেছি। কৃষকরা যে জাতগুলো নির্বাচন করেছেন সেগুলোর বীজ তাদেরকে পরবর্তী মৌসুমে চাষের জন্য দেওয়া হবে।’

IMG_20181115_145745-W600
কৃষক মোন্নাস মিয়া গবেষণা সম্পর্কে অনুভূক্তি প্রকাশ করে বলেন, ‘এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা নিচু জমিতে হয়, আগাম জাত, ফলন বেশি, রোগ-বালাই কম আক্রমণ করে, হেলে পড়েনা এমন ৫টি ধানের জাত পেয়েছি, যা আগামী মৌসুমে আমরা নিজেদের জমিতে চাষ করব। কিন্তু চাহিদার তুলনায় বীজের পরিমাণ কম হবে, তাই বারসিক এর নিকট আমাদের দাবি তারা যেন আমাদেরকে নির্বাচিত জাতের ধানের বীজ সংগ্রহ করে দেন। এই গবেষণা কার্যক্রমের মাধ্যমে আমরা জাত গবেষণার পদ্ধতি সম্পর্কে শিখতে পেরেছি।’

IMG_20181111_112456-W600
গবেষণা কার্যক্রমের শুরু থেকে সম্পৃক্ত স্কুল ছাত্র রুহুল আমিন তার অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘গবেষণার শুরু থেকে (বীজতলা তৈরি, বীজ বপন, চারা রোপণ, পার্চিং দেয়া, আগাছা বাছাই, নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন) সকল কাজে আমি ছিলাম। সার ছাড়া ও কীটনাশক ছাড়া ধান হবে তা প্রথমে বিশ্বাস হয়নি, কিন্তু চারা রোপণের মাসখানেক পর আগাছা পরিষ্কার করে দেয়ার পর ধানের কৃুশি বৃদ্ধি পেতে থাকে। জমিতে হাটু পানি জমে থাকলেও কুশির বৃদ্ধি থেমে থাকেনি। কঞ্চি পূঁতে দেয়ায় পাখি বসোর ফলে জমিতে পোকার আক্রমণ হয়নি। কোন রকমের সার ও কীটনাশক না দেয়ার পরও ধানের ফলন দেখে রাস্তায় চলাফেরা করা সকলে কৃষকরা বেশকিছু জাত পছন্দ করে। গবেষণার অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা নিয়ে আমরা বোরো মৌসুমেও ধানের জাত গবেষণা করতে চাই।’

IMG_20181111_114454-W600
কৃষক নেতৃত্বে এলাকা উপযোগি ধানের জাত নির্বাচনে প্রায়োগিক গবেষণার ফলে আমতলা ইউনিয়নের গাছগড়িয়া ও বিশ্বনাথপুর গ্রামের কৃষকরা গবেষণা কার্যক্রম সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পেরেছে। কোনরূপ রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ছাড়া শুধুমাত্র জমির খাদ্য জমিতে তৈরি করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে ধান চাষ করা যায় এবং পছন্দের জাত নির্বাচন করার গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষকরা শিখেছে। গবেষণার মাধ্যমে কৃষকরা এলাকা উপযোগি ৫টি ধানের জাত নির্বাচন করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে কৃষকরা নিজেরাই তাদের সমস্যা কিছুটা হলেও লাঘব করতে সক্ষম হবে বলে তারা আশা প্রকাশ করেছেন।

happy wheels 2

Comments