কৃষিতে নারীদের অবদান আজও স্বীকৃত নয়

মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক ॥

কথায় আছে, ‘যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে।’ যে নারী একদিনে পরম মমতায় আগলে রাখছেন সংসার, সেই নারীই শক্ত হাতে করছেন ফসল উৎপাদনের মতো মহৎ কাজ। আর এক্ষেত্রে পরিবার বা দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার পাশাপাশি কৃষি কাজে পিছিয়েও নেই মানিকগঞ্জের গ্রামীণ নারীরা। নিজস্ব মেধা আর কর্মদক্ষতা দিয়েই নিজ নিজ কাজে এগিয়ে যাচ্ছে নারী সমাজ। গৃহস্থালী কাজের পাশাপাশি পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ক্ষেত খামারের কাজেও সাহায্য করছেন গ্রামীণ নারীরা। বর্তমানে সবজি উৎপাদন ও বিপননের কাজে মানিকগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলায় বেশ ব্যস্ত কৃষি প্রধান পরিবারগুলো। এসব কাজেও সব রকমের সহযোগিতা করছেন মানিকগঞ্জের নারীরা।

আমাদের দেশে মোট শ্রমশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী। আর নারী শ্রমশক্তির মধ্যে ৭০ শতাংশ কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সঙ্গে জড়িত। কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে নারীর এ উপস্থিতির হিসাব নেই। এমনকি কৃষিকাজে জড়িত এ বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের কোনো মূল্যায়নও হয় না। তাদেরকে এই স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। বরং তারা সর্বত্র বৈষম্যের শিকার হচ্ছে।

1 (2)

গ্রামে বসবাসরত প্রতিটি নারীই নিজ নিজ পরিবারে কৃষি ও কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। প্রত্যক্ষভাবে কৃষি খামার কিংবা কৃষি জমিতে কাজ করা নারীর সংখ্যা কম হলেও আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে অনেক নারীকে এই খাতে শ্রম দিতে হয়। পারিবারিক প্রতিপত্তি ও সামাজিক মর্যাদার কারণে নারীরা নিজের ঘরে কিংবা খামারে পরিশ্রম করলেও তা প্রকাশে তারা অপারগতা জানান। গ্রামের প্রতিটি পরিবারে মা, স্ত্রী, কন্যা কোন না কোন ভাবে কৃষি সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত। কিন্তু ব্যাপারটি খুব একটা প্রকাশ্যে আসে না। এক্ষেত্রে ধর্মীয় অনুশাসন ও সামাজিক প্রতিবন্ধকতা কাজ করছে।

বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা সেলিনা পারভীন বানু এক বিবৃতিতে বলেন, ‘কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও ন্যায় মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে দেশের কৃষি উৎপাদন কাজে গ্রামীণ নারীরা আরও আগ্রহী হবেন। এর ফলে কৃষি খাতের উৎপাদন বাড়বে, জিডিপিতে কৃষির অবদানও বাড়বে। তাই কৃষিকাজে জড়িত নারী শ্রমিকদের মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করার সুযোগ নেই, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানও অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষি খাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও তাদের ন্যায্য মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে এ কাজে নারীরা আরও আগ্রহী হবেন এবং দেশে কৃষির উৎপাদন আরও বাড়বে।’

1 (3)

মানিকগঞ্জের সাতটি উপজেলাতেই কম বেশি সবজির আবাদ হয়। তবে জেলার ঘিওর, সিংগাইর, সাটুরিয়া এবং মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় সবজির আবাদ হয় সবচেয়ে বেশি। শীতকালীন সবজি চাষে ব্যস্ত এখন এসব এলাকার কৃষকরা। আবহাওয়া অনূকুলে থাকায় চলতি মৌসুমে সবজির ফলনও হয়েছে ভালো। রাজধানীর সঙ্গে উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে এসব এলাকার সবজির চাহিদাও বেশ। সব মিলিয়ে চলতি মৌসুমের সবজি চাষে লাভবান এখানকার কৃষকরা।

ঘিওর উপজেলার বরটিয়া হাকিম আলীর স্ত্রী ফরিদা আক্তার জানান, কৃষিকাজের উপর নির্ভর করেই তাদের সংসার জীবন। অল্প কিছু জমিতে ধান চাষ করে বাকি প্রায় তিন বিঘা জমিতে সবজি চাষ করেন। পরিবারের কাজ কর্ম শেষ করে তিনি নিয়মিতভাবেই তার স্বামীকে কৃষিকাজে সাহায্য করেন। এতে বাড়তি শ্রমিকের তেমন প্রয়োজন হয় না।
বায়রা এলাকার বিধবা রোকিয়া বেগম জানান, পরিবারে অভাব অনটনের জন্যে নিজে পড়াশোনা করতে পারেননি। স্বামী মারা গেছে প্রায় ১০ বছর আগে। নিজেদের কিছু জমি ও অন্যের জমি বর্গা নিয়ে সবজি আবাদ করে বেশ সুখেই আছেন। কলেজে পড়াশোনার পাশাপাশি কৃষি কাজে সহায়তা করে তার ছেলে রাকিব। আর এক মেয়ে এবার কলেজে ভর্তি হয়েছে। কৃষি খাতে আয়ের টাকা থেকেই চলছে তাদের সংসার এবং সন্তানাদীর পড়াশোনা।

বরাইদ এলাকার হরেন্দ্র পালের স্ত্রী আরতী পাল। ৩ সন্তানের জননী আরতী জানান, কৃষি প্রধান পরিবারেই বেড়ে উঠেছেন তিনি। বিয়েও হয়েছে কৃষকের সাথে। বাড়িতে তিনটি গরু পারলন করেন। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন আর ২ ছেলে পড়াশোনা করে। গৃহস্থালী কাজ শেষে ক্ষেত খামারের কাজেও সহায়তা করেন তিনি। এক সময় কৃষিকাজে লজ্জা ও কষ্ট হলেও এখন আর তেমন কষ্ট হয় না বলেও জানান তিনি। এছাড়া নিজের কাজ নিজে করার মধ্যে কোনো লজ্জা নেই বলেও জানান এই নারী।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা গনেশ চন্দ্র রায় জানান, চলতি মৌসুমে জেলায় ৭ হাজার ৯৭৫ হেক্টর জমিতে সবজির আবাদ হয়েছে। সবজির বাম্পার ফলনে বেশ লাভবান এখানকার চাষিরা। মানিকগঞ্জে পুরুষ সদস্যসের সঙ্গে নারীরাও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি কাজে অংশগ্রহণ করে থাকেন।

1 (4)

বেসরকারী উন্নয়ন ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক এর আঞ্চলিক কর্মকর্তা বিমল রায় জানান, গ্রামের প্রতিটি পরিবারে মা, স্ত্রী, কন্যা কোন না কোন ভাবে কৃষি সংশ্লিষ্ট কাজে জড়িত। কৃষিকাজে জড়িত এ বিপুলসংখ্যক নারী শ্রমিকের কোনো মূল্যায়ন হয় না। তাদেরকে এই স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। বরং তারা সর্বত্র বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। বৈষম্য দূর করে তাদের কাজের সঠিক মূল্যায়ন করলে কৃষি খাতে উৎপাদন, আয় ও মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। তিনি আরো জানান, কৃষক ও কৃষাণীদের কাজের সম্মান ও কৃষিতে আধুনিক প্রশিক্ষণ আর তাদের নিয়ে নিয়মিত মতবিনিময় সভা করে আসছে বারসিক। এতে মানিকগঞ্জের প্রান্তিক কৃষকরা উপকৃত হচ্ছেন।

মানিকগঞ্জ জেলা কৃষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. নজরুল ইসলাম জানান, মানবজাতির আদি পেশা হচ্ছে এই কৃষি। সভ্যতার সূচনাতে মানুষ প্রথমেই মাটিতে ফসল চাষ করা শেখে। আর এই কৃষির উৎপত্তি হচ্ছে নারীদের হাত ধরেই। দেশে বিভিন্ন পেশায়, বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীরা যেভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, কৃষিখাতেও ঘটছে তাই। এই ধারার অবসান হোক, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

happy wheels 2

Comments