চরের জ্বালানি সাশ্রয়ী বাহন
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
‘চরের কৃষকের মাল আনা নেওয়ায় বাহন হিসেবে ঘোড়ার গাড়ি শুধু সুসময়ে নয়, দুর্যোগে (বন্যার সময়), কাদা রাস্তায়ও চলে। শুধু রাস্তায় নয়, ফসল সংগ্রহে মাঠে চলে ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়ি চালাতে পেট্রোল, মবিলের প্রয়োজন হয় না, নষ্টও হয় না, চলে অবিরাম। কৃষকের বাড়ির উৎপাদিত খাবার পাইরার ভুশি, ধানের কুড়া, মাসকলাই ভুষি, ছোলা ও মাঠের ঘাস গোড়ার খাবার। আধুনিক যুগে ঘোড়া দিয়ে মালামাল বহন করানো যদিও খারাপ লাগে, তবে ঘোড়ার বাহন চরে মালামাল বহনে একমাত্র উপায়।’ উপরোক্ত কথাগুলো লেছড়াগঞ্জের হরিহরদিয়ার কৃষক নানু পরামাণিক (৬৫)।
হরিরামপুরের মোট ১৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি ইউনিয়নের উপর দিয়ে পদ্মা নদী বয়ে যায়। উপজেলার পদ্মা নদীর পশ্চিম ও দক্ষিণ দিকের পদ্মার চর। হরিরামপুরের চর এলাকায় প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পদ্মা নদীর পানি মাঠে প্রবাহিত হওয়ায় ফসলী জমিতে পলি পড়ে। ফলে চর এলাকায় মাঠে দেখা যায় বেলে দু’আশ মাটি। কৃষক-কৃষাণিগণ এই মাটিতে সহজে যে ফসল ফলান তা হলো ধান, গম, পায়রা, তিল, তিশি, শরিষা, ছোলা, খেসারী, মুগ, মসুরি, মাসকলই, ধনিয়া, রাধুনি, কালিজিরা, জিরনি, পিয়াজ, রসুন, ভুট্টা, কাউন, বাদাম, পাট, ধইঞ্চা, কলাসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি। চর এলাকার মানুষজন চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। কৃষকদের মাঠের ফসল সংগ্রহ ও বিক্রির জন্য বাহন হিসাবে ব্যবহৃত হয় ঘোড়ার গাড়ি। জ্বালানি সাশ্রয়ী ঘোড়ার গাড়ি তৈরিতে লাগে বাঁশ, লোহার তৈরিকৃত পাইপ ও চাকা। এলাকার লোকজন ঘোড়া গাড়ি চলার কারণ হিসাবে জানান যে, চরের রাস্তা-ঘাট কাঁচা, পাকা হয় নাই, বৃষ্টির সময় কাঁচা রাস্তায় এটেল মাটির জন্য খুবই কাঁদা হয়। এসকল রাস্তা দিয়ে চরের কৃষকদের মালামাল বা উৎপাদিত ফসল বহনের একমাত্র উপায় হলো এই ঘোড়ার গাড়ি।
এই প্রসঙ্গে লেছড়াগঞ্জের পাটগ্রামচরের ঘোড়ার গাড়ি চালক সোহরাব মোল্লা (৫৫) বলেন, ‘হরিরামপুর চর এলাকায় মালামাল টানার জন্য ঘোড়ার গাড়ির বিকল্প নাই। চরের বর্ষার পানি ও কেঁদা রাস্তায় অন্য কোন গাড়ি চলানো সম্ভব না। কিন্তু ঘোড়ার গাড়ি সারাবছর চলে। ফসল সংগ্রহ থেকে শুরু করে লোকজনের যাতায়াত, কৃষি ফসল ও দোকানপাটের মালামাল পরিবহনে সারাবছরই কাজে লাগে। চরে মালামাল বহন মানেই ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়াকে ঠিকমত খাবার দিলে ঘোড়ার গাড়ি সারাদিন চালানো যায়, নষ্ট হইব না, এই গাড়ি চলবই।’ তিনি আরে বলেন, ‘আমরা কৃষি আবাদ করি ফলে ঘোড়াকে ভালো খাবার মাসকলই ভুষি, খেসারি, পাইরা, ছোলা ও মাঠের ঘাস সহজে দিতে পারি। ভালো খাবারের জন্য ঘোড়া শক্তি পায়, কাঁচা রাস্তায় ঘোড়ার গাড়ি ভালো চলে ও পায়ের খোড় নষ্ট হয় না। প্রতিদিন ঘোড়ার গাড়ি থেকে রোজগার হয় ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা। পরিবার পরিজন নিয়ে ভালোই চলতে পারি।’
লেছড়াগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান সৈয়দ হাসান ইমাম সোনা বলেন, ‘চর জন্মের প্রায় ৩১ বছর ধরেই ঘোড়ার গাড়ি চলে আসছে। কৃষিপণ্য বহনে ঘোড়ার গাড়িই উপযুক্ত। চরের মানুষ সম্পূর্ণ কৃষির উপর নির্ভরশীল। চরে রাস্তা নাই বলেই চলে, জমির উপর দিয়ে রাস্তা। চরে ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে মাঠ থেকে ফসল সংগ্রহ করে থাকেন। চরে ইঞ্জিন চালিত গাড়ি কোনভাবেই সম্ভব নয়, কারণ রাস্তা ঘাট নেই। তবে ঘোড়ার গাড়িতে কাঁদা রাস্তায়ও জমির উপর দিয়ে মালামাল বহনে কোন ধরনের সমস্যা হয় না। চর এলাকায় ঘোড়ার খাবার ঘাস সংগ্রহ সহজ। একটি ঘোড়ার গাড়িতে করে ২০ থেকে ২৫ মণ পর্যন্ত মালামাল বহন করতে পারে। ট্রলারে পদ্মার ঘাটে মালামাল আসলে ঘোড়ার গাড়ি করে গন্তবে পৌছানো হয়। কৃষকের বিক্রয়কৃত ফসল ফরিয়াগণ পদ্মা নদীর পাড়ে আনার জন্য ঘোড়ার গাড়ি ব্যবহৃত হয়।’
বর্ষা মৌসুমে পদ্মা নদীর পানি চরের ফসলী মাঠে-ঘাটে বয়ে যাওয়া পলি মটি চরে জৈব কৃষি চর্চা ও কৃষি প্রাণবৈচিত্র্য আবাদে অত্যন্ত উপযোগি। চর এলাকার মাঠের ফসল সংগ্রহে প্রয়োজনীয় বাহন হলো জ্বালানি সাশ্রয় বাহন ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়ি দিয়ে মালামাল বহনে খরচ কম ও পরিবেশ উপযোগী। ঘোড়ার গাড়ি চরের সর্বসম্মত উপযোগী বাহন।