সেবা করতে গিয়ে আমার ভেতরে ভালো লাগার অনুভূতির জন্ম হলো
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে সাবিনা পারভীন
আমার নাম সাবিনা পারভীন। আমি শ্যামনগর উপজেলার কাশিমাড়ি গ্রামে স্বেচ্ছাসেবক টিম সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিমের একজন সদস্য। আমি কাশিমাড়ি এলাকার ফণির কবলে পড়ে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ফণি আসার পূর্বেও অবস্থা বা প্রস্তুতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্তভাবে আমার অভিজ্ঞতা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।
গত ৩ মে রোজ শুক্রবার মধ্যরাতে হানা দেয় বিশাল বড় ঝড় ফণি। প্রথমেদিনের বেলায় কাশিমাড়ি এলাকার মানুষেরা ভেবেছিলেন ফণি বাংলাদেশে আসবে না। কেননা তাদের সামনে আছে আমাদের সুন্দরবন। সেটি আমাদের ঝড়ের কবল থেকে রক্ষা করবে। তবুও ফণির আশঙ্কায় আমাদের সবকিছু প্রস্তুত ছিল। আমরা ফণি মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমিও আমার দলের সকল সদস্য মিলে প্রথমে আমাদের এখানে নির্দিষ্ট পরিসদে গিয়েছিলাম। সেখানে সকলে একত্রিত হয়ে হ্যান্ড মাইকের সাহায্যে সকলকে বিপদ সংকেত জানিয়েছিলাম এবং ঝড়ের কবল থেকে রক্ষার জন্য সকলকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম।
এটুকু করে আমরা থেমে থাকিনি। আমরা আমাদের এলাকার প্রত্যেকটি বাড়ি গিয়ে তাদেরসহ তাদের গৃহপালিত পশুপাখিদের নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার কথা বলেছিলাম। আমরা বাড়িতে বাড়িতে বলতে গিয়ে দেখি একজনের বাড়িতে কাটা ধান ভর্তি। তাঁরা বাড়ির সবাই মিলে কষ্ট করে তুলছে। আমরা সকলে মিলে তাদের কাজে সহায়তা করলাম। পাশের বাড়িতে একজন বৃদ্ধ মানুষ ছিলেন তাঁকে কিছু শুকনা খাবার দিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে দিয়ে আসলাম। ওখান থেকে আরো কিছু দুরে আরেকটি বাড়ি গিয়ে দেখলাম একজন গর্ভবতী মহিলা তাকেও আশ্রয়কেন্দ্রে রেখে আসলাম। তারপর বেলা ১২ টার দিকে বাড়ি ফিরলাম। বাড়িতে ফিরে বাড়ির আশেপাশে সকলকে সতর্ক করে দিলাম। যাদের কাচা ও মাটির বাড়ি তাদেরকে তাদের প্রয়োজনীয় দলিলপত্র ও কাগজাদি সংরক্ষণে রাখতে বললাম এবং আমাদের বাড়িটি ছিল ছাদের বাড়ি। সে জন্য সবাইকে আসতে বললাম তাদের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র নিয়ে এবং অনেকেই আসলেন।
এরপর দুপুরের দিকে যখন বৃষ্টি আসলো এবং বাতাস শুরু হলো তখন সবাই ভয় পেলো এবং বিশ্বাস করলো ফণি আমাদের দিকে আসবে। বিকাল বেলা আমাদের বাড়ির পাশে একটা দোকান ছিল। সে দোকান ঘর ও তাদের বাড়ি কাচা ছিল তারা দোকানের সবকিছু নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে উঠলো। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে আমাদের বাড়ির আশেপাশের অনেক মানুষ জড় হলো। তাদের ভালোভাবে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম এবং আমাদের দলের সাথে সার্বক্ষণিক ফোনে যোগাযোগ করতে লাগলাম। সারারাত জেগে সকলের সাথে যোগাযোগ করতে লাগলাম। একপর্যায় যখন মধ্যরাতে আবার ঝড় ও বৃষ্টি শুরু হলো তখন বুঝলাম যে ফনি এবার মনে হয় এসে পড়লো আমাদের মাঝে। সকলে খুবই ভয় পেলেন। তাদের সাহস দিলাম। মনে হলো যেন ফনী তার ফণা তুলেছে। সব জাযগায় ফোন দিতে থাকলাম এবং কোথায় কি হচ্ছে সেসব খোঁজখবর নিতে লাগলাম। হঠাৎ বাড়ির পাশ থেকে চিৎকার শোনা যাচ্ছে আমাদের এক প্রতিবেশীর ঘরের চালের টিন উড়িয়ে নিয়ে গেছে। ঝড় বৃষ্টি একটু কম হলে বেরিয়ে পড়ি দেখি কয়েকজনের ঘর ভেঙে গেছে। অনেকের ঘরের চালে টিন নেই পাশে কিছু জমিতে ধান ছিল সেগুলো লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। আমাদের যে আমগাছ ছিল সে আমগাছের অধিকাংশ আম পড়ে গেছে।
ফণির এ বিশাক্ত ফোনাতে এলাকার ৩০ জনকে আমরা আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলাম। সকালে যখন ঝড়ের প্রবণতা কমে গেছে তখন যে যার বাড়িতে চলে যান। এছাড়াও আমাদের দলের অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করে কাশিমাড়ি এলাকায় তেমন কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে তারা জানান। কাশিমাড়ি গ্রামের কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান যে, ২০০৭ সালে সিডর ও ২০০৯ সালে আইলায় যে ক্ষতি হয়েছে এ ফণি তেমন কোন বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারিনি। এছাড়াও আশ্চর্যকর ব্যাপার হলো এ পর্যন্ত কোন দিন দক্ষিণে ঝড় আসেনি এই সর্বপ্রথম দক্ষিণে ঝড় হলো এ ফণি। আমার মনে হয় ব্যাপক প্রস্তুতি, আগাম সতর্কবার্তা এবং সংগঠিতভাবে মানুষকে সচেতন করে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানোর কারণে ফণিতে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে। স্বেচ্ছাসেবক টিমের মাধ্যমে এ ধরনের জনসেবামূলক কাজ করার কারণে আমার ভেতরে অসম্ভব ভালোলাগার একটা অনুভূতি অনুভব করলাম। আমি মনে করি, আমরা যুব সম্প্রদায়েরা ইচ্ছা করলে সমাজ ও রাষ্ট্রের অনেক কল্যাণ ও উন্নয়নমূলক কাজ করার ক্ষমতা রাখি।