পশুপাখির সেবা করতে চাই-আশুরা বেগম
সাতক্ষীরা থেকে শাহীন ইসলাম
সাতক্ষীরার মাছখোলা গ্রামের অভিজ্ঞ ও দক্ষ কৃষাণী আশুরা বেগম। পশুপাখির ভ্যাকসিন দেওয়াই হচ্ছে তার পেশা! হাসপাতাল থেকে ঔষুধ কিনে গ্রামে গ্রামে ঘুরে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগির ভ্যাকসিন দিতে শুরু করেন। প্রতিটি ছাগল ২ টাকা, গরু ৪/৫ টাকা, হাঁস মুরগি এক টাকা করে নিয়ে ভ্যাকসিন দেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি ধীরে ধীরে এলাকায় বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করেন। এমন দিনও গেছে যখন তাকে দিনে ৩/৪শ গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ভেড়া, কবুতরের ভ্যাকসিন দিতে হয়েছে। কঠোর পরিশ্রমের কারণেই তিনি আজ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। এখন তিনি চান পশুপাখির সেবা করার। টাকার বিনিময়ে নয় বরং সেবার তাড়না থেকেই তিনি ভ্যাকসিন দেবেন বলে জানান।
কিভাবে এই পেশায় যুক্ত হলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “একদিন আমি অসুস্থ ছাগল নিয়ে পশু হাসপাতালে যাই। তখন পশু হাসপাতাল অফিসে অনেক নারী ছিল। তাঁরা পশুপাখির ভ্যাকসিন প্রশিক্ষণ নিতে এসেছিলেন। প্রশিক্ষণে একজন নারীর উপস্থিতি কম ছিল বিধায় আমাকে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে অনুরোধ করা হলো। আমিও কোনকিছু না ভেবে অংশগ্রহণ করলাম।” তিনি বলেন, “টানা ৭ দিন হাতে কলমে পশুপাখির ভ্যাকসিন শিক্ষা লাভ করি। এরপর ধুলিহরে ১৫ দিন এবং খুলনায় আরো ১৫ দিন প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। এভাবে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ভেড়া, কবুতরের রোগবালাই চিহ্নিত ও প্রতিরোধে ভ্যাকসিন প্রদানে জ্ঞান অর্জন করি।” এই প্রশিক্ষণকে বাস্তবে কাজে লাগানোর জন্যই তিনি মূলত এই পেশায় যুক্ত হয়েছে। এছাড়া পশু হাসপাতালের কর্মকর্তাদের পরামর্শও তাকে এই পেশা বেছে নিতে সহায়তা করেছে বলে তিনি জানান।
প্রতিদিন তাঁর বাড়িতে মানুষ পরামর্শ নিতে আসেন। তিনিও এ কাজে মনোযোগী হয়ে উঠেন। এই পেশায় যুক্ত হওয়ার পর থেকে তিনি অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তিনি বলেন, “এই কাজের ফলে পরিবারের অভাব অনাটনও ঘুচে যায়। এক ছেলে ও মেয়েকে মেট্রিক পাস করিয়েছি। ঘরবাড়ি করতে পেরেছি।” তিনি দীর্ঘদিন ধরে মাছখোলা, পারমাছখোলা, বেজুরডেঙ্গি, দামারপোতা, বাগডাঙ্গা, শ্যাললে, বেড়াডেঙ্গি, সদুরডেঙ্গি গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পশুপাখির ভ্যাকসিন দিয়েছেন। তিনি জানান, বেতনা নদীর মৃত্যুর ফলে গত ৪/৫ বছর বর্ষাকালে এলাকায় ভয়াবহ জলাবদ্ধ থাকে। মানুষ ঠিকমত চলাচল করতে পারে না। গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি বন্দি অবস্থায় থাকে। ফলে, নানান রোগে অসংখ্য পশুপাখি মারা যাচ্ছে। তিনি বলেন, “নিয়মিত ভ্যাকসিন দিতে পারলে মানুষসহ পশুর অনেক উপকার হতো। কিন্তু সরকারি/বেসরকারী সংস্থা এলাকায় কাজ করলেও পশুপাখির স্বাস্থ্য বা চিকিৎসা নিয়ে কারও কোন উদ্যোগ নেই।”
ওষুধের অভাবে তিনি এখন আর আগের মতো পশুর ভ্যাকসিন দিতে পারেন না। মাছখোলা গ্রামের অনেক নারীই তাদের পশুপাখির ভ্যাকসিন দিতে না পারায় পশু-পালনে সমস্যাগ্রস্ত হচ্ছে। তারা বলেন, “জলাবদ্ধতা কাটিয়ে খুব কষ্ট করে গরু, ছাগল, হাঁস মুরগি রক্ষা করেছি। এখন যদি ভ্যাকসিন দিতে না পারি তাহলে মড়ক লাগবে।” আশুরা যদি আগের মতো ভ্যাকসিন দেওয়ার কাজ শুরু করে তাহলে তাদের অ
নেক উপকার হবে। মাছখোলা গ্রামের নারীদের অনুরোধে গত জানুয়ারি মাসে বারসিক আশুরাকে ভ্যাকসিন কিনে সহায়তা করে। অতঃপর আশুরা গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রায় শতাধিক পরিবারের গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগির ভ্যাকসিন দেন। কাজটি চলমান আছে। আশুরা বেগম প্রতিতিন মাস পর পর ভ্যাকসিন সেবা দেওয়ার কাজ করবেন বলে জানান তবে সেটি পেশা হিসেবে নয়; সেবা হিসেবে। আবারও প্রাণীর সেবা করার সুযোগ পাওয়ায় আশুরা অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, “বারসিকের ঔষুধ সহায়তায় আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে পশু-পাখির ভ্যাকসিন দেবো। আগে অভাব ছিল, তাই টাকার বিনিময়ে কাজ করেছি। তখন এটা আমার পেশা ছিল। এখন আমার স্বামী, সন্তান আয় করে। সংসারে অভাব অনাটন নেই। তাই বাকি জীবন পশুপাখির সেবা করতে চাই।” আশুরার লালিত স্বপ্ন সফল হোক এটাই আমাদের প্রত্যাশা।