কৃষক ও করোনা, নাকি করুণায় কৃষক
নেত্রকোনা থেকে হেপি রায়
“আমি বিএনপি করিনা, আওয়ামীলীগও করিনা, আমি নেতা না আমি একজন কৃষক। আমি রাজনীতি বুঝিনা আমি বুঝি আমার জমিন ক্যামনে চাষ করণ লাগবো, ক্যামনে ফসল পাওন লাগবো। এই দু:সময়ে যদি একটু সাহায্য পাইতাম, সরকার যদি একটু নজর দিতো, তাইলে খায়া পইরা বাইচ্যা থাকতাম”। অনেক আক্ষেপের সুরে, মনে তীব্র একটা যন্ত্রণা নিয়ে কথা বলছিলেন কৃষক খায়রুল ইসলাম। নিজের তেমন জমি নেই। অন্যের জমিতে কাজ করেন বহু বছর ধরে। করোনা পরিস্থিতিতে কাজ আছে তবে মনে শান্তি নেই। কৃষি কাজে সহাযোগিতা করে মজুরি বাবদ যে টুকু ধান পেতেন তা খাওয়া বাদ দিয়ে বিক্রি করতে পারতেন। এবার তাও পারবেন কিনা জানেন না।
বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে সমগ্র বিশ্ব স্থবির হয়ে আছে। উন্নত দেশগুলোতেও বন্ধ হয়ে আছে শিল্পের চাকা। শিল্প প্রধান অনেক দেশই যেখানে করেনার ভয়াল ছোবলে থেমে আছে সেখানে আমাদের মতো জনঅধ্যুষিত দরিদ্র দেশের বেহাল দশা হওয়ারই কথা। আমাদের দেশের শতকরা ৭২ ভাগ উৎপাদন আসে কৃষি থেকে। মুখে মুখে বলতে শোনা যায় কৃষি ও কৃষকের দেশ, বাংলাদেশ-বাংলাদেশ। অথচ এই কৃষকেরা বর্তমান পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে আছে সেটা কি কেউ তলিয়ে দেখছি।
প্রথমে দেখে নেয়া যাক করোনা সংকট মোকাবেলায় সরকার প্রদত্ত কি কি প্রণোদনা আছে আমাদের কৃষকের জন্য। কৃষির জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা আছে মাত্র ৫% সুদে। ডেইরী, মৎস, পোলট্রি খামারিরাও এর অন্তর্ভূক্ত। ৯,৫০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এছাড়া ৮ লাখ মে: টন ধান, ২১লাখ মে: টন কৃষিজ পণ্য, ১০ লাখ মে: টন চাল, ২লাখ ২০ হাজার মে: টন আতপ চাল ও ৮০ হাজার মে: টন গম কিনবে সরকার। এই পরিমাণ কৃষিজ পণ্য কি আদৌ কৃষকরা সরাসরি বিক্রি করতে পারবেন ? (সূত্র: প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ-২৭.০৪.২০২০)।
বিক্রির কথায় পরে আসি। এখনো ধান কাটা চলছে। সরকার সকল নেতা-কর্মীকে নির্দেশ দিয়েছেন কৃষকের ধান কেটে দিতে। এই কাজটি শুধু প্রচারণার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আসল ঘটনা অন্য জায়গায়। নেতা কর্মীরা জমিতে গিয়ে ধানের গুছি ধরে ছবি তোলেন। দেখে বোঝার উপায় নেই তারা আদৌ ধান কেটে শেষ করেছেন কিনা। কারণ পুরো জমিতে ধান কাটা শেষ করেছেন এমন ছবি প্রচার মাধ্যমে আমরা দেখিনা। ছবি তুলে ফেইসবুকে আপলোড দেয়া পর্যন্তই তাদের কাজ। জমির ধান জমিতেই পড়ে থাকে। যা পরে কৃষককেই কেটে নিয়ে আসতে হচ্ছে। তাহলে কোন ধরণের সহযোগিতা পাচ্ছেন আমাদের কৃষক।
বর্তমান সময়ে শ্রমিক সংকটের আশংকায় বিভিন্ন শ্রেণি, পেশার জনগোষ্ঠীকে ধান কাটায় যুক্ত হতে বলা হচ্ছে। কিন্তু গ্রাম পর্যায়ে এখনো তেমন শ্রমিক সংকট দেখা দেয়নি। যারা সব সময় অন্যের জন্য শ্রম দিয়ে থাকেন, তারা এখনো প্রস্তুত। কিন্তু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে অন্য জায়গায়।
যারা গ্রাম ছেড়ে শহরে বাস করছিলেন বর্তমানে করোনা পরিস্থিতিতে তারা সবাই এখন নিজ বাড়িতে অবস্থান করছেন। এ সময়ে শ্রমিকের ভূমিকায় তারাই অবতীর্ণ হয়েছেন। নিজেদেরসহ আত্মীয়দের ধান কাটায় তারা সহযোগিতা করছেন। তবে বিনা পারিশ্রমিকে নয়। বর্তমানে ধান কাটার কাঠা প্রতি শ্রমিক মূল্য ৬’শ টাকা। এ টাকাতেই তারা অন্যের জমির ধান কেটে দিচ্ছেন। এ কারণে গ্রামের শ্রমিকরা বেকার বসে থাকছে। অন্য এলাকায় গিয়ে যে কাজ করবে তার কোনো উপায় নেই। কারণ সেখানেও একই অবস্থা।
শহুরে মানুষরা ধান কাটছে বলে সব ধরণের জমির ধান নয়। উঁচু জমির ধান কাটলেও নিচু জমিতে যেতে চায়না। কারণ কৃষকের সন্তান হয়েও তারা এখন শহুরে জীবন যাপনে অভ্যস্থ। তাই পানিতে নেমে ধান কাটা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছেনা। পড়ে থাকা জেরের জমির ধান অভাগা কৃষক/শ্রমিকদেরকেই কাটতে হয়। তাদের কারণে ধান কাটা জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে বলে পারিশ্রমিকও কম পাচ্ছে। ফলে অর্থের অভাব কৃষক/শ্রমিকদের থেকেই যাচ্ছে।
এবার আসি ধান বিক্রি বিষয়ে। সরকার ঘোষণা দিয়েছেন এবছর বোরো মৌসুমে ৮ লাখ মে: টন ধান ন্যায্য মূল্যে ক্রয় করবেন। এখানেই চলছে সবচে’ বড় শুভঙ্করের ফাঁকি। গত আমন মৌসুমে কৃষকদের যে তালিকা করা ছিল, বর্তমানে সেটি যাচাই বাছাই করা হচ্ছে।
চকপাড়া গ্রামের কৃষক মানিক মিয়া ও তার ভাই মিলে ১৩০ কাঠা জমিতে ধান চাষ করেছেন। মানিক মিয়া ও তার স্ত্রীর নামে দুটি কার্ড আছে। মজার বিষয় হলো কার্ড থাকা স্বত্তেও এবারের তালিকায় তাদের নাম নেই। তথ্য সংগ্রহ করে জানা যায় এ তালিকায় তাদেরই নাম আছে যাদের কাছে বিক্রি করার মতো কোনো ধান নেই। এই সুযোগে স্থানীয় বেপারীরা ন্যায্য মূল্যে ধান বিক্রি করছে। যে কৃষকের জন্য এই ব্যবস্থা, তার হাতে কিছুই আসছেনা। মধ্যসত্তভোগীরা সব লুটে নিচ্ছে। শুধু ধানের বেলায় যদি এমন হয় তবে অন্যান্য ফসলের ক্ষেত্রে কি হবে ?
করোনাকালীন এই দুর্যোগ মূহূর্তে পৃথিবী জুড়েই কৃষিজাত দ্রব্য সরবরাহ বিঘিœত হচ্ছে। অনেক কৃষকের সব্জী ফসল ক্রেতার অভাবে মাঠেই পঁেচ যাচ্ছে। রমজান মাসের এই সময়ে অন্যান্য বছর ৯’শ থেকে ১ হাজার টাকায় যেখানে প্রতি মণ শশা বিক্রি হতো, বর্তমানে ১’শ থেকে দেড়শ’ টাকায় তা বিক্রি করতে হচ্ছে। সরকার এত রকমের প্রণোদনা ঘোষণা করার পরও দিন শেষে কৃষকের ভাঁড়ার শূন্য।
এ বছর বোরো ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা ২ কোটি ৪লাখ মে: টন হলেও আশা করা হচ্ছে এবারের ধান উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাকেও ছাড়িয়ে যাবে। সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে ধান ক্রয় করা না গেলে বেপারী, মিল মালিকরাই লাভবান হবে। তাই কৃষককে প্রণোদনা দিতে চাইলে এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন কোনো কৃষক ক্ষতিগ্রস্থ না হয়। ছোট, বড় সকল কৃষকের কাছ থেকে ধান কিনতে হবে এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে সেটি করতে হবে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে যে কৃষক ফসল উৎপাদন করেন সেই কষ্টার্জিত ফসলের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করা না গেলে অসাধু ব্যবসায়ী ও মুনাফা লোভীদের পকেট ভরবে।
এই দুর্যোগকালে ধানের সঠিক মূল্য নিশ্চিত করা না গেলে আগামী আমন মৌসুমে কৃষকের ধান চাষে কোনো আগ্রহ থাকবেনা। কারণ কৃষি কাজে খরচ দিন দিন বাড়ছে। যে কৃষকের ৫০কাঠা জমি আছে, প্রতি মৌসুমে চাষের ব্যয় মেটাতে গিয়ে তাকে হয়তোবা ৫ কাঠা করে জমি বিক্রি করতে হবে। কৃষক যদি ধান উৎপাদন, বিক্রি করতে না পারে তবে সামনে দিনগুলোতে আমাদের খাদ্য নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে পড়ে যাবে। তাই নিজের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থেই আমাদের কৃষকের পক্ষে কথা বলতে হবে।