বীজ সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখছে কৃষকের বীজবাড়ি
সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান, বিউটি সরকার ও শারমিন আক্তার
বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ কৃষি কাজের সাথে জড়িত। কৃষিকে কেন্দ্র করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করেন। তাছাড়া উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তিই কৃষি। প্রান্তিক ভূমিহীন দরিদ্র কৃষকই এই চালিকা শক্তির মেরুদন্ড। কিন্তু যখন কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ কৃষির উপর আঘাত হানে তখনই বিপর্যস্ত হয় কৃষি, ভেঙে পড়ে অর্থনীতি। আবহওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষকের ফসল। পরবর্তীতে ফসল চাষাবাদে কৃষক পড়েন বীজ সংকটে।
এক সময়ে বীজ সংকট নিরসনে গ্রামীণ নারীরা নিজেদের স্থানীয় বীজ সংরক্ষণ করতেন এবং দুর্যোগকালীন বীজ সংকটে সেই বীজ ব্যবহার করতেন। তাছাড়া কৃষকদের মধ্যে বীজ বিনিময় ছিল কৃষির আদি ঐতিহ্য। পারস্পারিক বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে তৈরি হতো আন্তঃসম্পর্ক। কৃষকের নিয়ন্ত্রণহীন কৃষিব্যবস্থা, কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ, কোম্পানি ও বাজারনির্ভর হাইব্রিড বীজের আগমন এবং কৃষির আধুনিকীকরণ হওয়ার ফলে কৃষকের এই প্রচলিত বীজ বিনিময় প্রথা হারিয়ে যেতে বসেছে। অধিক জনসংখ্যার দেশ হিসেবে খাদ্য ঘাটতি পূরণে অধিক ফসল উৎপাদনে উচ্চ ফলনশীল ফসল চাষাবাদে অনেকাংশে স্থানীয় জাতের বিলুপ্তি হচ্ছে।
তবে কৃষকের প্রচলিত বীজ বিনিময় প্রথা, লোকায়ত কৃষির চর্চা এবং স্থানী জাতে চাষাবাদ করার যে আদি ঐতিহ্য সেটি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন মানিকগঞ্জের সিংগাইর অঞ্চলের বায়রা, বলধারা ইউনিয়নের, সন্তোষ মন্ডল, ঈমান আলি, ইব্রাহিম মিয়া সেলিনা বেগম, শহিতন বেগম, রোকেয়া বেগম, রাজিয়া বেগম, লিপিকা মন্ডল, রেনু বেগম শহীতন বেগম, মনোয়ারা বেগম নামের কৃষক ও কৃষাণীরা। তাদের মতে, কৃষিকাজের মূল উপকরণ হলো বীজ। কৃষকরা এই বীজ স্বাধীনভাবে ব্যবহার করবেন। যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিকভাবে কৃষকের উৎপাদিত বীজ চাষাবাদ, সংরক্ষণ ও বিনিময় করে কৃষি কৃষকের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। কোম্পানিনির্ভর না হয়ে কৃষকের সংরক্ষিত বীজই কৃষকদের মধ্যে বিনিময়ের মাধ্যমে যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করবে। কৃষকরা নিজেদের স্থানীয় জ্ঞান ব্যবহার করে বীজ সংরক্ষণ করে থাকেন। বীজ সংরক্ষণ ও বিনিময়ের জন্য তাঁরা গড়ে তুলেছেন ছোট ছোট বীজবাড়ি। এই বীজবাড়ি থেকেই কৃষকদের মধ্যে বীজ বিনিময় করার প্রথা চালু হচ্ছে বলে তারা জানান।
বীজ বাড়ীতে সংরক্ষিত বীজ রেজিষ্টার তথ্যানুযায়ী ডাটা, লালশাক, পালংশাক, শিম, দেশীলাউ, মিষ্টিকুমড়া, ধুন্দল, চালকুমড়া, ঝিংগা, চিচিংগা, কালিজিরা, ধনিয়া, মাসকালাই ইত্যাদি স্থানীয় জাতের বীজ রয়েছে এবং বীজ সংকট নিরসনে ২৫০ জন কৃষক কৃষাণির মধ্যে এ বীজগুলো বিনিময় করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে বাংগালা নবকৃষক কৃষাণি সংগঠনের বীজবাড়ী সংরক্ষণকারি কৃষক সন্তোষ মন্ডল বলেন, ‘নিজের বীজ রাখি, সময়মত জমিতে বীজ বপন করি, চাষ করার পর যে বীজগুলো অবশিষ্ট থাকে সেগুলো বীজবাড়িতে জমা রাখি এবং কৃষকদের মধ্যে বীজ বিনিময় করি। এভাবেই আমরা যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে বীজ সংকট নিরসন করি।’
অন্যদিকে বায়রা গ্রামের কৃষাণী রোকেয়া বেগম বলেন, ‘নিজেদের কাছে বীজ থাকলে যে কোন সময় চাষ করা যায়। নিজেদের সংরক্ষণ করা বীজের মানও ভালো থাকে। বাজার থেকে যেন কোন বীজ ক্রয় করতে না হয় সে জন্যই আমরা এই বীজবাড়ি তৈরি করেছি। এবার বন্যায় আমাদের চাষ করা ফসল নষ্ট হয়ে যায়। অনেক কৃষকের কাছে বীজ না থাকায় বীজবাড়ি থেকে কৃষকের মাঝে বীজ বিনিময় করি। এতে করে আমাদের বীজের ঘাটতি কিছুটা পূরণে বীজবাড়ি ভালো ভুমিকা রেখেছে।’
উল্লেখ্য বারসিক মানিকগঞ্জের সিংগাইর অঞ্চলের কৃষকদের সংগঠিত করে,কৃষকের অধিকার আদায়, স্থানীয় জাত চাষে উৎসাহিতকরণ, বৈচিত্র্যময় ফসল উৎপাদন, জৈবসার, জৈববালাই নাশক এর ব্যববহারে উদ্বুদ্ধকরন, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, কৃষক কৃষক বীজ বিনিময়, সংরক্ষণ, এবং বীজবাড়ি তৈরিতে সহায়তা করে আসছে।