পানিসাশ্রয়ী রবিশস্য আবাদ করে সফল কৃষক মো. লিয়াকত আলী

রাজশাহী থেকে অমৃত সরকার
গ্রামের চারপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু মসুরের জমি আর জমি। বলছিলাম রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামের কথা। এ গ্রামের একজন কৃষক মোঃ লিয়াকত আলী (৪৮)। পিতা মৃত নূর মোহাম্মদ। এইএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করে কোন চাকুরির চেষ্টা না করে বাবা ও দাদার আদিপেশা কৃষিকেই বেছে নিয়েছিন। এখান থেকেই পরিবর্তন করতে চেয়েছেন নিজের অবস্থা ও অবস্থান। নিজের জমি বলতে ৪ বিঘা। প্রথম থেকেই চেষ্টা করে গিয়েছেন নিজের এ পেশাকে কিভাবে লাভজনক করে তোলা যায়। কিন্তু কোন কিছুতেই যেন কিছু হয়ে উঠছিলো না। শুধু ধান চাষ করে উৎপাদন খরচ মিলিয়ে লাভ তেমন কিছুই থাকত না। বরেন্দ্র বীজ ব্যাংক থেকে বীজ সহযোগিতা নিয়ে দেশী জাতের ধান যেটা বাজারমূল্য বেশি তাও চাষ শুরু করেন। এ ধানগুলোতে উৎপাদন খরচ কম হয় তাতে কিছু লাভ থাকে। এমনভাবেই চলছিলো। এরপর কিছু জমি লিজ হিসেবে নিয়ে বেশি করে ধান চাষ শুরু করেন বেশি লাভের আশায়। কিন্তু বরেন্দ্র অঞ্চল হওয়ায় প্রতি মৌসুমেই পানি সমস্যার জন্য ফলন কমে যেত। এতে করে আবার খরচ বেড়ে যেত। তিনি লক্ষ্য করেছেন, আমন মৌসুমের ধান বৃষ্টিনির্ভর হলেও ধানের শীষ পর্যায়ে এসে পানি সংকটের কারণে ফলন কমে যেত।


২০১৪ সালের রবি মৌসুমে বরেন্দ্র্র্র্র্র বীজ ব্যাংক ও বারসিক’র সহযোগিতায় দুবইল গ্রামে ৪জন কৃষককে ২০ কেজি মসুর বীজ সহযোগিতা করা হয়। এই চারজন কৃষকের মধ্য মোঃ লিয়াকত আলী একজন কৃষক যিনি মসুর বীজ পেয়েছিলেন একবিঘা জমিতে চাষ করার জন্য। সেখান থেকেই আসলো পরিবর্তন শুরু। এ বিষয়ে লিয়াকত আলী বলেন, ‘আমি তখন রবি শস্য চাষ বিষয়ে তেমন জানতাম না, বারসিক থেকে আমাকে বীজ সহযোগিতা দেওয়া হলো এবং কিছু কারিগরি সহযোগিতাও। আমি নিজে খুব ভালোভাবে প্রথম বছরের রবিশস্য চাষ প্রত্যাক্ষ করে খুটিনাটি বিষয়গুলো লক্ষ্য করেছি। তাতে করে বুঝতে পেরেছিলাম এ ফসলটি চাষ করে আমিসহ আমাদের এলাকার কৃষক লাভবান হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রথমবার আমি ৮ মণ মসুর পাই একবিঘা জমি থেকে। কেজি বীজ বরেন্দ্র বীজ ব্যাংকে ফেরত দিয়ে আমি ৮০ কেজি বীজ সংরক্ষণ করি পরের বছর চাষ করার জন্য। ৬ মণ মসুর বিক্রয় করে সব খরচ বাদ দিয়ে ১৪ হাজার টাকা লাভ হয়। আমাদের বাকি ৩জন কৃষক ঠিক একইভাবে উপকৃত হয়।’

দুবইল গ্রামে সে সময় প্রচুর পরিমাণে সেচনির্ভর বোরো ধানের চাষ হতো। পাশাপাশি হতো আলুর চাষ। কম জমিতে মসুরসহ অন্যান্য রবিশস্য চাষ হতো বলে মাঝে রবিশস্যর জমিতে পাশের ধান অথবা আলুর জমি থেকে পানি চলে এসে রবিশস্যও ক্ষতি সাধন করত। এ বিষয়ে মো. লিয়াকত আলী বলেন, ‘আসলে সে সময় মসুর চাষকে অনেকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করত না, তবে এখন দিন পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের গ্রামে এখন খুবই কম পরিমাণে বোরো চাষ হয়, রবিশস্য চাষ এখন অনেক বেশি।’


মোঃ লিয়াকত আলী এখন নিজের ৪ বিঘা জমিসহ লিজ নিয়ে ১৯ বিঘা জমিতে চাষবাস করেন। এর মধ্য চলতি রবি মৌসুমে ১০ বিঘা জমিতে মসুর, ২ বিঘা জমিতে মটর, একবিঘা জমিতে সরিষা, ৭ বিঘা জমিতে আলুর চাষ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ৬ বছরে মসুর বা রবিশস্য চাষে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি। আমার রবিশস্য চাষে ফলন ভালো হয় বলে আশেপাশের অনেক গ্রামের কৃষকরা আমার থেকে পরামর্শ করতে আসে। আমার থেকে বীজ সহযোগিতা নিতে আসে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এবারের চলতি রবি মৌসুমে আমি সাহাপুর, প্রকাশনগর, কোয়েলহাট ও দুবইল গ্রামের ২৮জন কৃষককে ৯২ বিঘা জমিতে মসুর, ৭ বিঘা জমিতে মটর, ১০ বিঘা জমিতে সরিষা, ৫ বিঘা জমিতে খেসারি চাষের পরামর্শ ও কৃষকের থেকে ভালো বীজ পেতে সহযোগিতা করেছি। যাদের মধ্য অনেকেই বোরো ধান চাষের প্রস্তুতি নিয়েছিল। দুবইল গ্রামে এবার চাষ হয়েছে ৩৭৫ বিঘা মসুর, ১১ বিঘা মটর, ৫বিঘা খেসারি ও ৪৫ বিঘা জমিতে সরিষার চাষ।’


এ বিষয়ে গ্রামের সমাজ সেবক ও সাবেক ইউপি মেম্বার মোঃ জায়েদুল ইসলাম (৫৫) বলেন, ‘লিয়াকত আলী আশেপাশের গ্রামের কৃষকের থেকে রবি শস্য চাষে অনেক এগিয়ে আছে। তিনি এধরনের ফসল চাষ করেই তিন ছেলেকে পড়াশোনা করাচ্ছেন, ভালো একটি বাড়ি তৈরি করেছেন। সব থেকে বড় যে উপকার হচ্ছে আর তা হলো আমাদের এই বরেন্দ্র অঞ্চলে ফসল চাষে যে পানি সমস্য আছে তা সমাধানে অনেক বড় ভূমিকা রাখছে তাঁর এ কাজ।’

happy wheels 2

Comments