বিলুপ্তির ঝুঁকিতে খাসি আদিবাসীদের ভাষা-নৃত্য-সঙ্গীত

সিলভানুস লামিন

ভূমিকা
বাংলাদেশে প্রায় দুই মিলিয়নেরও বেশি আদিবাসী বাস করে। সংখ্যাগত দিক থেকে বাংলাদেশে কতগুলো স্বতন্ত্র আদিবাসী নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী রয়েছে বা বসবাস করছে তার সঠিক কোনও পরিসংখ্যান আজ পর্যন্ত সরকারি নথিপত্রে পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ সরকার ‘আদিবাসী’ শব্দ নিয়েও বেশ কয়েক বছর আগে আপত্তি করেছে। সরকার বলেছে, বাংলাদেশে কোন আদিবাসী নেই; যারা আছে তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী! স্বাভাবিকভাবেই সরকারি কোন নথিতে আদিবাসী শব্দটি আজ উধাও! তবে আদিবাসীরা তাদেরকে ‘আদিবাসী’ হিসেবে পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দ্ববোধ করে। সুশীল সমাজ এবং মিডিয়াও ‘আদিবাসী’ শব্দটিই বেছে নিয়েছে। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের হিসেব অনুযায়ী বাংলাদেশে ৪৫টিরও অধিক স্বতন্ত্র আদিবাসী নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্ত মানুষ বসবাস করে। তার মধ্যে খাসি অন্যতম। স্মরণাতীতকাল থেকে খাসিরা বাংলাদেশের সিলেট বিভাগের মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ এবং সিলেট জেলায় বসবাস করে আসছেন। তাঁরা সিলেট বিভাগের অধীনে তিনটি জেলার টিলা ও পাহাড়ে পান চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। এছাড়া পানের পাশাপাশি তাঁরা সুপারি, লেবু, আনারস, কাঁঠাল আবাদ করেন। বাংলাদেশে খাসি জনসংখ্যা নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেকে দাবি করেন যে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ হাজারের মতো খাসি জনগোষ্ঠী বসবাস করেন।


গবেষক ও বিজ্ঞানীদের মতে, খাসি জনগোষ্ঠী বৃহত্তর অস্ট্রিক মানবগোষ্ঠীর অংশবিশেষ, যা অস্ট্রিক প্রটো-অস্ট্রেলয়েড বা ভেড্ডী নামেও পরিচিত। সিলেটের আদি বাসিন্দা বা প্রথম আবাস স্থাপনকারী মানবগোষ্ঠী হলো অস্ট্রিক মানবগোষ্ঠী। পরবতীর্তে এ অঞ্চলে মঙ্গলয়েড টিবোটো বর্মণ এবং আর্য সম্প্রদায়ের আগমন ঘটে। দৈহিক গঠন ও বৈশিষ্ট্যে মঙ্গলীয় ছাপ থাকলেও উৎপত্তি, ঐতিহ্য, ভাষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মঙ্গলীয় জনগোষ্ঠী থেকে খাসিরা ভিন্ন। যেহেতু খাসিরা হচ্ছে বৃহত্তর অস্ট্রিক মানবগোষ্ঠীর অংশবিশেষ সেহেতু গবেষক বা বিজ্ঞানের এই ধারণা ও অনুমান সত্য হলে খাসিরা এই দেশের আদি বাসিন্দা; বহিরাগত নয়। সিলেট জেলার অর্ন্তগত জৈন্তাপুরে খাসি রাজাদের প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ এখনও রয়েছে; যা এ দেশে খাসিদের দীর্ঘদিনের বসবাসের স্মৃতিচিহ্ন বহন করে।

খাসি ভাষা, নৃত্য, গান ও বাদ্যযন্ত্র
খাসিদের সংস্কৃতি খুবই সমৃদ্ধ ছিলো এক সময়ে। তবে নানান কারণে আজ এ সংস্কৃতি বিলুপ্তির দিকে ধাবিত হয়েছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে বসবাসকারী খাসিরা বলতে গেলে ভাষা ছাড়া তাদের সংস্কৃতি হারিয়েই ফেলেছে। বাংলাদেশে খাসিদের গ্রামে সংস্কৃতি বলতে নিজস্ব পোশাক-আশাক পরিধান ও ভাষা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। তবে যখন কোন পার্বণ ও উৎসব হয় তখন খাসি নাচ ও গান পরিবেশন করা হয়। চর্চার অভাবে এবং সংরক্ষণের কোন উদ্যোগ না নেওয়ায় খাসিদের এসব নাচ, গান ও বাদ্যযন্ত্র আজ বিলুপ্তির পথে। এই লেখায় খাসিদের সংস্কৃতির কিছু উপাদান যেমন গান, নাচ ও বাদ্যযন্ত্র নিয়ে আলোচনা করবো।

ভাষা
একটি জাতি বা গোষ্ঠীর ভাষাও তার আদি বাসস্থান বা জাতিগত উৎপত্তির তথ্য বহন করতে পারে। ভাষাবিদদের গবেষণা থেকে জানা যায় যে, খাসি ভাষা বৃহৎ মনখুমের ভাষার একটি শাখা যা, অষ্ট্রো এশিয়াটিক নামে পরিচিত। জে আর লগান, পেটার স্মিথি, জি ই গ্রিসন এবং অন্যান্য গবেষকদের মতে, খাসি ভাষা দূর প্রাচ্যের মনখুমের ভাষার উপশাখা বিশেষ যা বার্মার (মায়ানমার) ‘মন’ সম্প্রদায়, কাম্পুচিয়ার খুমের সম্প্রদায়, ভিয়েতনামিজ, বার্মার রিয়াং পালুং, থাইলান্ডের লেমেট খুমু, কম্বোডিয়ার বাহনার নানাং, ইন্দোচীনা এবং মালয়েশিয়ার জনগোষ্ঠীর ইত্যাদি ভাষার সাথে সম্পর্কযুক্ত। অন্যদিকে ভারতের কল, মুন্ডা ও সাঁওতাল ভাষার সাথেও খাসি ভাষার কিছুটা মিল খুজে পাওয়া যায়। তবে ব্যাকরণ, শব্দচয়ন ও শব্দ গঠনে অনেক পার্থক্য বিদ্যমান। সিলেট ও সিলেট সংলগ্ন খাসিয়া জৈন্তিয়া পাহাড়ের খাসি ‘ওয়ার’ আঞ্চলিক ভাষার সাথে মনখুমের (কম্বোডিয়ান) ভাষার নৈকট্য অধিক পরিলক্ষিত হয়। উত্তর পূর্ব ভারত ও বাংলাদেশে একমাত্র খাসি ভাষাই ‘মনখুমের ভাষার ধারক ও বাহক। ভারতে পশ্চিম আর্য বংশের উত্থান, উত্তর হিমালয়ের ক্ষুদ্রজাতি, পূর্ব ও দক্ষিণে মঙ্গোলীয় জাতির দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকা সত্ত্বেও খাসি ভাষা তার বিশেষত্ব ও স্বকীয়তার ধারণ করে আছে। দূর প্রাচ্যের সাথে খাসি ভাষার সাদৃশ্যতা এটাই প্রমাণ করে যে, প্রাচীন যুগে ভারতের কল, মুন্ডা এবং খাসি এবং দূরপ্রাচ্য ইন্দোচীনা মানবগোষ্ঠীর মধ্যে একটি সম্পর্ক বজায় ছিলো। ভাষার মধ্যে এই সান্নিধ্যতার কারণে অনেক গবেষকই মনে করেন যে, বৃহৎ অষ্ট্রিক মানবগোষ্ঠীর ভাষা প্রাচীন যুগের কোন সভ্য জাতির ভাষা থেকেই সূত্রপাত লাভ করেছিল। তবে ভারতের কল, মুন্ডা, সাঁওতাল ও ওরাঁওদের দৈহিক গঠনের সাথে অন্যান্য মনখুমের ভাষাভাষীর দৈহিক গঠনের কোন মিল নেই। অন্যদিকে ডব্লিউ গ্রহাম মনে করেন যে, মন আনাম পরিবার অর্থাৎ আদি খাসি পরিবারের ভাষার সাথে প্রাক দ্রাবিডিয়ান ভাষার সাদৃশ্যতার প্রধান কারণ হলো যে, প্রাচীন যুগে আদি ‘কলমুন্ডা’ সম্প্রদায়ের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিলো। ফলে এ দুই বর্ণের ভাষার মধ্যে মিল খুজে পাওয়া যায়। এ সম্পর্কে শরৎ চন্দ্র রায় মন্তব্য করেন যে, প্রাচীন যুগে এ অঞ্চলে (ভারত ও বাংলাদেশ) কোলারিয়ান ভাষাভাষী মানুষ বাস করতো। তারা একই বর্ণগোষ্ঠী থেকে উৎপত্তি হয়েছে এবং তাদের পূর্বপুরুষরাই ভারতের প্রথম আবাস স্থাপনকারী মানবগোষ্ঠী। ভাষাগত দিক থেকে খাসিদের সাথে কল, মুন্ডা ও সাঁওতালদের সাদৃশ্যতা থাকলেও বর্ণ ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে খাসিরা বৃহৎ মনখুমের অংশ বিশেষ। আরেকটি উল্লেখ্যযোগ্য দিক হলো, বাংলাদেশের খাসিরা বেশির ভাগই ‘ওয়ার’ ভাষাই কথা বলে এবং ওয়ার ভাষার অনেকগুলো উপভাষা রয়েছে।

নৃত্য
খাসিদের নৃত্যানুষ্ঠানে সাধারণত যুবক ও যুবতীগণ অংশগ্রহণ করে থাকে। ‘যুদ্ধ নাচ’ বলে বিশেষ নৃত্যে বয়স্ক পুরুষরাই অংশগ্রহণ করে থাকেন। পুরুষরা নৃত্যে সাজসজ্জ্বা ও পোশাক পরিচ্ছদ ব্যবহার করে থাকেন। এ যৃদ্ধ নাচের জন্য বয়স্করা কাধে ও বুকে জড়ানো সিল্ক কাপড়, মাথার পাগড়ি, লাল ধুতি, পিছন থেকে ঝুলানো পাখির লেজ, স্বর্ণের মালা, কোমড়ে বাঁধা দড়ি বিশেষ পরিধান করেন এবং হাতে তলোয়ার ও ফুল বিশেষ ইত্যাদি থাকতো। পুরুষরা বিজয়ী বীরের রূপ ধারণ করে নৃত্য পরিবেশন করে। বাম হাতের কাপড় দলিয়ে ডান হাতের তলোয়ার ঘুড়িয়ে মাঝে মাঝে চিৎকার করতে হয় সহযোদ্ধাদের উজ্জ্বীবিত এবং প্রতিপক্ষদের আক্রমণ করতে যাবতীয় প্রস্ততি নেওয়ার জন্য। খাসিদের ৩ ধরণের নৃত্য রয়েছে।

ক) Shad Khalek (খালেক নুত্য): এ নৃত্যে সকল পুরুষ অংশগ্রহণ করতে পারে এবং সাজসজ্জ্বার ক্ষেত্রেও তেমন কোন বাচ বিচার ও কড়াকড়ি নেই। এটা একটি গণ-পুরুষ নৃত্য। সঙ্গীতের তালে সকলে চারিদিকে হৈহুল্লা করে নাচতে নাচতে বিভিন্ন ধরণের ছড়া পরিবেশন করে দর্শকদের আনন্দ দান করে থাকে।

খ) Shad Mastieh (বীর নৃত্য): খালেক নৃত্য থেকে এটার পার্থক্য হলো যে, এ নাচে পুরুষরা তলোয়ার ও আত্মরক্ষার জন্য ঢাল ব্যবহার করে থাকে। এটা যুদ্ধে ফেরত বিজয়ী বীরদের বিশেষ নৃত্য। এক্ষেত্রে যুবতী নাচের দল দুটি দলে বিভক্ত হয়ে পরস্পর বিরোধী তলোয়ার উত্তোলন করে এবং যুদ্ধাবস্থার ন্যায় কেশারত প্রদর্শন করে থাকে।

গ) ধর্মীয় বা আনন্দঘন নৃত্য: এ অনুষ্ঠানে নারী পুরুষ অংশগ্রহণ করে থাকে। কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান, স্মৃতি প্রস্তর উত্তোলন পর্ব, এবং কোন বিশেষ আনন্দঘন মুহুর্তে এ ধরনের নাচ পরিবেশিত হয়। জয়ন্তিয়া রাজ্যে নংতালাং নামক পুঞ্জিতে কোন ব্যক্তি বাঘ শিকার করে ঘরে নিয়ে আসলে তার বংশকে এই ধরণের নাচের আয়োজন করতে হয়। এটিকে রংখিø (বাঘপর্ব) বলা হয়। এছাড়া পাহাড়ে নৃত্যগীত, দুঃখীনৃত্য, সাধারণ নৃত্য, নালা ঢোল নুত্য, ঘেরা নৃত্য, ধন্যবাদ নৃত্য ইত্যাদি নৃত্য বিভিন্ন মৌসুমে ও পার্বণে আয়োজন করা হয়। নৃত্যগীত মানুষের মনে ও হৃদয়ে আনন্দ ও বেদনার কথা জাগিয়ে তুলে। এই সমস্ত নৃত্যের নিগুরতত্ত্ব অনুধাবন করতে না পারলে এগুলোকে নিছক হৈ হুল্লা ও রূপ প্রদর্শন মনে হতে পারে। খাসিদের কাছে নৃত্যের আনন্দ ও অর্থ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নৃত্যের তত্ত্ব বুঝতে না পারলে নৃত্য হতে কোন আনন্দ ভোগ করা সম্ভব নয়।

সংগীত/গান
খাসিরা মূলত সংগীত প্রিয় জাতি। খাসি সঙ্গীতে মূর্ছনা মূলত দুঃখী হৃদয়ের বহিঃপ্রকাশ থেকেই উদ্ভাসিত হয়েছিলো যা অধ্যাত্মিক ধ্যান ধারণার সাথে সম্পৃক্ত। স্বভাবত সেই কারণেই খাসি সঙ্গীতের সর্বপ্রথম ও প্রধান মূলসুর হচ্ছে ঈশ্বর সৃষ্টিকর্তার অন্বেষণ এবং তার আরাধনা ও প্রশংসা করা। খাসিদের অধিকাংশ সঙ্গীতই দুঃখের ভাষায় রচিত এবং ভারাক্রান্ত হৃদয়ের সুরে গাথা। তাদের আনন্দের লেজমাত্রা খুবই কম। এ সম্প্রদায়কে সম্ভবত বিভিন্ন দুঃখ কষ্টের মধ্যে সংগ্রাম করতে হয়েছে বলেই তাদের সংগীতের মধ্যে বেদনার কাহিনীই বেশি প্রস্ফুটিত হয়েছে। খাসি সঙ্গীতকে নি¤œলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়।

ক) ধন্যবাদ গান
এ ধরণের সংগীতে ঈশ্বরের ধন্যবাদ ও প্রশংসা করা হয়। ফসল তোলার মৌসুমে ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠত্বের প্রশংসা, ঈশ্বরের কাছে যাচনা ও প্রার্থনা, পূজা পার্বণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এই ধরনের সঙ্গীত প্রযোজ্য। এ ধরনের সঙ্গীত খুব সহজে রচনা করা সম্ভব নয়। বয়স্ক মানুষ ও পুরোহিতগণই এই ধরনের সঙ্গীত রচনা ও সুর দিয়ে থাকেন। এটি অতৃপ্ত অথবা অসন্তোষ হৃদয়ের কথা বলে। আধ্যাত্মিক সর্ম্পকিত সকল গান ও সুরই এর অর্ন্তভুক্ত। ন¤্র ঢোল ও তালের মূর্ছনার এগুলো পরিবেশিত হয়।

খ) প্রকৃতির গান
এ সমস্ত গানে প্রকৃতির রূপ যৌবন ও সৌন্দর্যকে নিয়ে রচিত। সাধারণ বাঁশির মধুর সুরে এগুলো প্রস্ফুতিত হয়ে উঠে। সাধারণত রাখাল বালকগণই এই সমস্ত গান ও সুরের সৃষ্টিকারী।

গ) গল্প কাহিনী ভিত্তিক গান
এ সমস্ত সংগীতে দোতারা বাদক তার বাজনার তালে তালে একটি কাহিনী বর্ণনা করে থাকেন। গ্রামে হাটবাজারে এগুলোর প্রচলন বেশি। খাসিদের ক্ষেত্রে এর ভিন্ন বৈশিষ্ট হলো যে, বাদক-গায়ক গানগুলো মধ্যরাতে পরিবেশন করে থাকে। অতীতে কোন ঘটনাকে বর্ণনা করে বর্তমানের প্রেক্ষাপট টেনে আনা হয়। গানগুলোতে প্রেম ভালোবাসার কাহিনী প্রধান্য পেয়ে থাকে। গানগুলো তরুণ তরুণীদের প্রচুর আনন্দ দিয়ে থাকে। গায়কদের মধ্যে মাঝেমাঝে গান নিয়ে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়ে থাকে।

ঘ) ঘুম পড়ানো সুর
এ সমস্ত গান সন্তানকে ঘুম পাড়ানোর জন্য ব্যবহার হয়ে থাকে। মাথা বা পিঠে হাত দিয়ে মা সন্তানকে বিভিন্ন সুরে গুণ গুণ করতে করতেই ছেলেমেয়ের ঘুম চলে আসে। এগুলো খাসি সমাজে এখনো প্রচলিত আছে।
একটি গানের উদাহরণ
ঘুমিয়ে পড়ো প্রিয় মোর/
ঘুমিয়ে যাও/
পৃথিবী নিস্তর নিঃশব্দ/
পাখিদের কোন গান নেই/
বাঘ মামা ডাকছে/
শিয়াল ডাকছে/
অয় অয়/অয়/
ঘুমিয়ে পড়ো বাবা আমার/
সুখে ঘুমাও/
দূত তোমায় ঘিরে রাখবে/
স্বপ্নের দেশে ঘুরে বেড়াবে/
ঘুমাও ঘুমাও সুখে ঘুমাও ইত্যাদি।

ঙ) ফাওয়ার
এই সমস্ত সুর ও গান বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও দলগত কর্মে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এগুলো অতীতকালের সুপ্রিয় সঙ্গীত ছিলো। ফাওয়ার বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। তীর ধনুক প্রতিযোগিতায় একজন ব্যক্তি কতগুলো লাইন গেয়ে যাবে। দলের বাকি সদস্য হুই হুই ্িকউ কিউ বলে চিৎকার করতে থাকবে। বাঘ শিকার, ভালুক বা হরিণ শিকার করে গ্রামে নিয়ে আসলে সেই আনন্দে বিভিন্ন ধরনের ফাওয়ারে আকাশ বাতাস ভরপুর থাকে। কোন বিশেষ উপলক্ষে যখন বৃহৎ প্রস্তর উত্তোলন করা হয় তখন সতীর্থদের শক্তি যোগার করার জন্য বিশেষ ফাওয়ার গান ব্যবহৃত হয়ে থাকে। এই ফাওয়ার গানের সাথে গণনৃত্যও পরিবেশিত হয়ে থাকে। কোন আনন্দনুষ্ঠান বনভোজন ও খেলাধূলাতে বিজয় লাভ করলে এ ধরনের গান অপরিহার্য। এ সমস্ত গানে বাদ্যযন্ত্র ব্যবহৃত হয় না।

চ) দুঃখের গান
খাসিয়ারা অতীত ঘটনার কথা এবং কাহিনী নিয়ে গান করতে পছন্দ করে। এক্ষেত্রে দুঃখ ব্যথার কাহিনীই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। জীবনের ব্যর্থতা, আত্মীয়স্বজনের মৃত্যুর ব্যথা, হারানো প্রেম ভালোবাসা এবং অতীত হারিয়ে যাওয়া সুখের কথাগুলো অত্যন্ত করুণ সুরে গাওয়া হয়। এই সমস্ত সঙ্গীত লোক কাহিনী ও উপকথায় ব্যর্থ ও করুণ কাহিনী থেকেই সুত্রপাত ঘটেছিলো। উপকথার সেই ময়ুর পাখি কিভাবে সূর্য্যের সাথে ভালোবাসাকে বিসর্জন দিয়ে পৃথিবীতে পা রেখেছিলো, একটি দরিদ্র দুঃখী মেয়ে কিভাবে তার ভালোবাসার স্বপ্ন পুরুষকে হারিয়ে ফেললো এ সমস্ত কাহিনী নিয়েই এই সব গান রচিত হয়।

ছ) বিলাপ সংগীত
খাসিরা মৃতদেহকে খুব শ্রদ্ধা করে থাকে। একজন ব্যক্তি মারা যাওয়ার পরপরই তাকে মাটি দেয়া বা পোড়ানো হয় না। তার নিকট আত্মীয়স্বজনদের খবর দিতে হয়। ফলে মৃতদেহ এক রাত ঘরে রাখতে হয়। এ সময়টুকুতে তার আপনজন করুণ কান্নার সুরে বিলাপ করে থাকে। বর্তমান পৃথিবীতে এ রকম বিলাপ সঙ্গীত বিরল। এ রকম বিলাপ পৃথিবীর কোন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে পাওয়া যায়নি। ছন্দ ও কবিতার করুণ ও মিশ্র সুরে মৃত ব্যক্তির বংশের কাহিনী, তার জীবনী, কর্মকান্ডসহ ইত্যাদি স্মরণ করে এ বিলাপ সঙ্গীত গেয়ে শুনানো হয়। এটাকে খাসি ভাষায় ‘ছহনিয়া’ বলা হয়। যে কোন গ্রাম থেকে অভিজ্ঞ শিল্পীগণ একত্রিত হয়ে একজন শিল্পীর পরিচালনায় গানগুলো আবৃত্তি করা হয়। মাঝে মাঝে দূর দূরান্তের শিল্পীদের মধ্যে প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। মৃতদেহ শ্মশানে বা কবরে নিয়ে যাওয়ার প্রাককালেও তার স্বজনরা এ ধরনের কান্নার সুর ব্যবহার করে থাকে। বর্তমানে এ সঙ্গীত দিন দিন বিলুপ্ত হচ্ছে। পারিপার্শিকতা, বহিঃসংস্কৃতির প্রভাব, দারিদ্রতা ও শিল্পের প্রতি অনিহার কারণে এইগুলোর চর্চা নেই বললেই চলে।

বাদ্যযন্ত্র
বাদ্যযন্ত্র একটি সমাজ বা সম্প্রদায়ের সংস্কৃতির বিশালতাকে ইঙ্গীত প্রদান করে। বর্তমান যুগের পাশ্চাত্য বাদ্যযন্ত্রের প্রভাবের ফলে অনেক আদিবাসীদের বাদ্য যন্ত্রই দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। খাসিয়াদের অনেক ধরনের আদি বাদ্যযন্ত্র বিদ্যমান। এই গুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। অনেক যন্ত্র শুধু মধ্যরাতেই ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আবার অনেক বাদ্যযন্ত্র যেগুলো দিনে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। খাসিয়াদের বাদ্যযন্ত্র অন্য আদিবাসীদের তুলনায় ব্যতিক্রম এবং এর সুরও ভিন্ন এবং আকর্ষণীয়।

১. বেশলী বা বাঁশি (Besli)
খাসিয়ারা বাঁশি বাজাতে খুব পছন্দ করে। বিভিন্ন বাশি বিভিন্ন কায়দায় ব্যবহার করতে হয়। বাঁশের বাঁশি ছাড়াও ‘শাংওয়িং’ নামক বাঁশি পাওয়া যায় যা বিশেষ অনুষ্ঠানে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

২. শারতী (Sharati)
শারতি নামক এক বাঁশের বাশি শুধুমাত্র মৃত সৎকারের অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। করুনকাহিনির এই বাঁশির উৎপত্তি নিয়ে একটি লোককাহিনী জড়িত। মানিক রাইটং নামক এক কিংবদন্তি নায়ক এই বাঁশির প্রবক্তা ছিলেন। ‘লিয়েং মাকাও’ নামক এক অসুখী রাজবধু তার স্বামীর অনুপস্থিতিতে একদা এই মানিক রাইটং এর বাঁশির করুণ মধুর সুরে মুগ্ধ ও বিহবল হয়ে পড়ে। অবশেষে রানী তার প্রেমে পড়ে এবং ব্যভিচারের মতো মহাপাপে লিপ্ত হলো। খাসি সমাজ এ ধরনের পাপ কোনভাবেই সহ্য করতে পারেনা। রাজা বিদেশ থেকে এসে রানীর কোলে এক শিশুসন্তান দেখে চমকিত হয়ে গেলেন। তিনি তার পিতৃপরিচয় জানতে চাইলেন, কিন্তু রানী নিশ্চুপ। পরে উপদেষ্টাগণ এক বুদ্ধি বের করলো। রাজ্যে সকল পুরুষকে ডেকে আনা হলো। হাতে কলা নিয়ে প্রত্যেকে শিশুটিকে প্রলোভিত করলো। শিশুটি কারো দিকেই নড়লো না। অবশেষে জানা গেল যে, মানিক এই পরীক্ষা দিতে আসেনাই। তৎক্ষণাৎ মানিক রাইটং বাঁশি হাতে নিয়ে উপস্থিত হন এবং এক মহৎ ঘটনার সৃষ্টি হলো। রানীর কোলের পুত্র সন্তানটি সহজেই তার কলার দিকে হাত বাড়ালো। সে কৃতকর্মের স্বীকার করলো। এই ঘটনার সমাপ্তিতে মানিক রাইটং এবং রানী উভয়ই জলন্ত অগ্নীকুন্ডে নিজেকে সমর্পন করলো। তার হাতের বাঁশি উল্টোভাবে মাটিতে গেথে দিলো, সেখান থেকে বাঁশ গজিয়েছে যার পাতা উল্টানো। এ ঘটনার পর থেকেই মৃত সৎকাজে শারতি বাঁশি ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

৩. টাংমুরি
বাদ্যযন্ত্রটি কাঠ দিয়ে তৈরী এবং সম্মুখ ভাগে নরম (রীড) জিনিস গাঁথা । এটার সাতটি ছিদ্র আছে। এটার হুবুহু ইংলিশদের ‘ব্যাগ পাইপ’ এর মত। এটা বাজাতে প্রচন্ড বাতাস ও শ্বাস প্রশ্বাস দরকার। টাংমুরি সাধারণত আনন্দ অনুষ্ঠানে ব্যবহৃত হয়। এটার সাথে তবলা ব্যবহার করতে হয়।

৪. টাংলড
এটা এক প্রকার বাঁশের বাঁশি যা ক্ষুদ্র বাঁশ দিয়ে তৈরি। এটি সাধারণত বাঁশি থেকে ছোটখাট এবং মুখে ঢুকিয়ে বাজাতে হয়। নৃত্য অনুষ্ঠানে এটা ব্যবহার করা হয়। এছাড়া জাপুং নামক আরেক ধরনের ছোট বাঁশি পাওয়া যায়। সাধারণত রাখালরা এ ধরনের বাঁশি ব্যবহার করে থাকে।

৫. দুইতারা ও মারেনথিং
দুতারা বাংলার দু’তারার ন্যায় মুকা তারের বাদ্যযন্ত্র। মারেনথিং নামক দুতারাটি সাধারণত দুতারা থেকে একটু লম্বা। খাসি দুইতারাতে তার সংযোজন করা হয়। মারেনথিং এ সীতারের ন্যায় তার সংযোজন করতে হয়। কোন কোন মারেনথিং এ পাঁচটি তার থাকে আবার কোন কোনটাতে শুধু চারটি তার সংযোজন করতে হয়।

৬. মারেংগড
এটি হুবুহু গীতার বা দুতারার মতই তবে এটা বেহেলার ন্যায় ধনুক দিয়ে বাজাতে হয়। এগুলো সাধারণত রাতে ব্যবহার করতে হয়।

৭. সেতার
বাঙালির ন্যায় অতীতে খাসিরা সেতার বাজাতে পারদর্শী ছিলো।

৮. মিয়েং
এটা বাঁশের টুকরা দিয়ে তৈরি একধরনের বাদ্যযন্ত্র। বাশের টুকরা পরিস্কার করে এটার মধ্যে একটি ক্ষুদ্র ছিদ্র দিয়ে জিহবা তৈরি করতে হয়। এ জাতীয় যন্ত্র অনেক পাহাড়ী জাতির মধ্যে দেখতে পাওয়া যায়।

৯. ঢোল
খাসিদের অনেক ধরনের ঢোল বিদ্যমান। যেমন সেংবম বা বড় ঢোল দুমদুম বা হাতের ঢোল, বমরিট বা মহিলা ঢোল। নৃত্য সঙ্গীতে ঢোলের অবদান অনেক এবং এর শব্দ অনেক বেশী ও দূর থেকে শোনা যায়।

উপসংহার
এক সময় খাসি সমাজ ও সংস্কৃতি খুব সৃমদ্ধ ছিলো বলে শোনা যায় কিংবা বিভিন্ন খাসি লেখকের লেখনিতে জানা যায়। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের খাসি সংস্কৃতি ও সমাজ নানা কারণে বিপন্ন। শিক্ষা-দীক্ষার হার কম হওয়ার কারণে সমাজের উন্নয়নে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, বা সমাজের আচার-অনুষ্ঠান চর্চার মাধ্যমে কীভাবে সংস্কৃতিকে ধরে রাখা কিংবা সমাজটাকে আরও গতিশীল করা যায় সে সম্পর্কে আমাদের সমাজ নেতাবৃন্দের পর্যাপ্ত জ্ঞান ও ধারণা দু’টিই নেই। ফলে আস্তে আস্তে খাসি সমাজের মৌলিক বৈশিষ্ট্য থেকে সরে এসে বর্তমান প্রজন্মরা মূলধারার প্রাধান্যশীল সমাজ ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। তাই তো আজ প্রাধান্যশীল সমাজব্যবস্থার সংস্কৃতি খাসিদের সমাজের সংস্কৃতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রবেশ করেছে; নতুন প্রজন্মরা সে সংস্কৃতি চর্চা করছে। প্রাধান্যশীল সংস্কৃতির সহচার্যতায় বেশি আসার কারণে নতুন প্রজন্মরা তাদের নিজের সংস্কৃতিকে ‘বিদেশি’ সংস্কৃতি বলে মনে করতে শুরু করে। দৈনন্দিন জীবন-যাপনে এই সংস্কৃতি চর্চা থেকে তারা বিরত থেকেছে কিংবা খাসি সংস্কৃতি চর্চা করতে লজ্জা পাচ্ছে। অন্যদিকে প্রধান্যশীল সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থার সাথে সংস্পর্শে বা সহচার্যতার আসার সাথে সাথে সেই সমাজের সংস্কৃতি হারিয়ে যেতে শুরু করে। বাংলাদেশে বসবাসরত খাসিদের জীবনব্যবস্থার প্রায় পুরোটা সময় ধরেই মূলধারার মানুষের সাথে ওঠাবসা, আদান-প্রদান ও মিথস্ত্রিয়া করতে হয়। দীর্ঘদিন ধরে মিথস্ত্রিয়ার কারণে মূলধারার সংস্কৃতি খাসি সমাজের সংস্কৃতিতে প্রবেশ করে এবং আস্তে আস্তে সেই সংস্কৃতি খাসিদের জীবনব্যবস্থায় শেকড় গাড়ে। এভাবে প্রতিনিয়ত মূলধারার সমাজব্যবস্থা ও সংস্কৃতির সাথে মিথস্ক্রিয়ার কারণে খাসি সমাজের নিজস্ব কাঠামো, সংস্কৃতি হারিয়ে যায়। শিক্ষা-দীক্ষার অভাবের কারণে অনেক খাসি নিজস্ব সংস্কৃতির গুরুত্ব উপলদ্ধি করার মতো বুদ্ধিবৃত্তিক সক্ষমতা না থাকায় এসব প্রাধান্যশীল সংস্কৃতিকে আকড়ে ধরে। এছাড়া বাংলা ভাষার মাধ্যমে শিক্ষালাভের কারণে সমাজের শিক্ষিত অংশরা এই ভাষার ও সমাজের বিভিন্ন কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ভাষা, গৌরবগাঁথা, ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত হয় এবং এটি চর্চা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে খাসি সংস্কৃতি, ভাষা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের সরকারি ও বেসরকারিভাবে কোন উদ্যোগ নেই। খাসি শিশুরা তাদের মাতৃভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ পায় না। শিক্ষিত অংশের বেশির ভাগ খাসি মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য পুঞ্জি (গ্রাম) থেকে দূরে থাকেন। খাসি সংস্কৃতি, ভাষা চর্চার জন্য সাধারণ খাসিদের উদ্বুদ্ধ করার মতো সহায়ক খুঁজে পাওয়া যায় না। কিছু এনজিও ক্ষুদ্র পরিসরে খাসিদের সংস্কৃতি ও ভাষা চর্চা বিষয়ক ইস্যুতে কাজ করলেও সেগুলো মূলত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান ও নাচের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

(কৃতজ্ঞতা: বনিফাস খংলা, আঞ্চলিক পরিচালক, কারিতাস সিলেট ও রুশ পতাম: খাসি লেখক)

happy wheels 2

Comments