মিনতী রানীর প্রাণবৈচিত্র্যসমৃদ্ধ কৃষি খামার

সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল

এক সময় উপকূলীয় কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের প্রতিটি কৃষিবাড়িই ছিল এক একটি খামার। স্থানীয় পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদের রূপ/আকার পরিবর্তন করে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষ একটি কৃষি বাড়ি/খামার তৈরি করতো। একটি/দুইটি বসত ঘর, বীজ ঘর, গোয়াল ঘর, হাঁস-মুরগির ঘর, জ্বালানি ঘর, সবজি ক্ষেত, মিষ্টি পানির পুকুর, ধান ক্ষেত, বসতভিটার চারিধারে ফলজ ও বনজ গাছের বাগান, ঢেঁকি ঘর, গোলাঘর ইত্যাদি ছিল একটি কৃষি পরিবারের স্বাভাবিক কাঠামো, যার মাধ্যমে ওই পরিবারের টেকসই জীবনযাপন নির্বাহ হতো। কিন্ত জলবায়ু পরিবর্তন এ প্রভাবে উপকূলীয় কৃষিপ্রতিে রে চরমভাবে ক্ষত-বিক্ষত। তবুও পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে উপকূলীয় কৃষি পরিবারের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছেন কিছু কিছু পরিবার।

বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের কৃষাণী মিনতি রানী (৪৪) নিজের প্রচেষ্টায় টিকিয়ে রেখেছেন প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ কৃষিবাড়ি। শৈশবকাল থেকে বাবা-মা-কাকা-কাকীর কাছ থেকে তার কৃষি কাজের সূচনা। বিয়ের পর স্বামীর সংসারে এসেও সেই কৃষির সাথে সরাসরি জড়িয়ে পড়েন।
২০২১ সালে অক্টোবর মাসে নেটজ পার্টনারশিপ ফর ডিভেলপমেন্ট জাস্টিস’র সহযোগিতায় বারসিক’র বাস্তবায়নে পরিবেশ প্রকল্প শুরু হলে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের বুড়িগোয়ালিনী গ্রামে ময়না সিএসও দলে যুক্ত হয় মিনতি রানী। যুক্ত হওয়ার কিছুদিন পরে বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে তার পারিবারিক ও ব্যবসায়িক উন্নয়ন পরিকল্পনার প্রেক্ষিতে উৎপাদনশীল সম্পদ হিসেবে তাকে দুটি ভেড়া ও ৪টি মুরগি সহযোগিতা করা হয়। সম্পদ সহযোগিতা পাওয়ার পরে বারসিক পরিবেশ প্রকল্প থেকে নানা ধরনের কৃষি প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ প্রদান করা হয়। যার ফলে নিজের কৃষি খামারকে আরো সমৃদ্ধ করার সুযোগ পান তিনি।

মিনতী রানীর স্বামী অরুণ হালদার (৫০) দিনমজুরের কাজ করলেও একমাত্র ছেলেকে খুলনা থেকে হিসাব বিজ্ঞানে পড়ালেখা সমাপ্ত করিয়েছেন। ছেলে মনোরঞ্জন হালদার এখন চাকরিপ্রার্থী হিসেবে পড়ালেখা নিয়ে ব্যস্ত আছেন। একমাত্র মেয়ে ভগবতী হালদার স্থানীয়ভাবে একটি এনজিও তে কাজ করছেন বলেই তাদের পরিবারের স্বচ্ছলতা কিছুটা কমেছেন বলে জানালেন মিনতি রানী নিজেই।

মিনতি রানীর ১০ শতক বসতিভিটায় বারোমাসই নানা ধরনের সবজি চাষ করতে পারেন। কেননা তার ছোট একটি স্বাদু পানির পুকর রয়েছে। বারসিক থেকে কৃষি বিষয়ে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ পেয়ে নিজের কৃষি উদ্যোগকে আরো প্রভাবিত করতে পেরেছেন খুব সহজেই। তিনি এখন ৬টি ভেড়ার মালিক এবং ৩০টি মুরগি রয়েছে তাঁর। ভেড়ার বিষ্ঠা (নাদি) থেকে ফসল উৎপাদনের জন্য সার তৈরি করেন এবং পরিবারের জ¦ালানি হিসেবেও তিনি ব্যবহার করেন। মুরগির বিষ্ঠাও তিনি উপযুক্ত করে কৃষিতে ব্যবহার করেন। নিজের হাতে তিনি জৈব সার ও ভার্মি কম্পোষ্ট সার উৎপাদন ও ব্যবহার করেন। পুকুরে রয়েছে স্থানীয় জাতের মৎস্য প্রজাতি। মিনতি রানী নিজের হাতে উৎপাদিত ফসলের বীজ সংরক্ষণ করেন পরবর্তী সময়ে লাগানোর জন্য।

উপকূলীয় লবণাক্ত পরিবেশে মিনতি রানীর প্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ খামার উপকূলসহ বাংলাদেশের প্রতিটি কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের কৃষিঐতিহ্য, অস্তিত্ব, সংস্কৃতি এবং স্থায়ীত্বশীল জীবনযাত্রার দিকনির্দেশনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মডেল, যা কিনা আগ্রহীদের আরও বেশি সাহসী ও উদ্যোগী হতে ভূমিকা রাখবে।

happy wheels 2

Comments