কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা চর্চায় অদিতি রানীর উদ্যোগ
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিটি পরিবারে একসময় প্রায় নানান ধরনের প্রাণবৈচিত্র্য ভরপুর ছিলো। প্রতিটা বাড়ি বা পরিবারের বাইরের দৃশ্য দেখলে বোঝা যেতো যেতো কতই না সম্পদ ছিলো। বাড়িগুলোতে বিভিন্ন ধরনের শস্য ফসলের সাথে প্রতিটি পরিবারে ছিলো নানান ধরনের গবাদি পশু। উপকূলীয় এলাকায় ঘন ঘন প্রাকৃতিত দুর্যোগ, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ এবং বাণিজ্যিক হারে কৃষি ফসল উৎপাদনের কারণে সবকিছু বিলীন হওয়ার উপক্রম হয়েছে। কিন্তু শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজস্ব জ্ঞান অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা এবং কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা চর্চার মাধ্যমে গ্রাম বাংলা অসংখ্য নারী এখন প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে খাদ্যের সার্বভৌমত্ব টিকিযে রেখে চলেছেন। তেমনই একজন সেরা সফল উদ্যোক্তা শ্যামনগর উপজেলার শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের কালমেঘা গ্রামের কৃষাণী অদিতি রানী (৪৪)।
অদিতি রানীর মোট জমি প্রায় ৫ বিঘা। তার মধ্যে দুই বিঘা জমিতে ধান চাষ এবং দুই বিঘা জমিতে মাছ চাষ করেন। আর বাকি একবিঘা বসতভিটা যেখানে বছরব্যাপী নানান ধরনের ফসল চাষাবাদ করেন। বাড়িতে বর্তমান মৌসুমের জন্য লাউ, মিষ্টিকুমড়া, বরবটি, বেগুন, ঢেড়স, পুইশাক, শসা, উচ্চে, ওল, উচ্ছে, তরুল, শিম, কঢ়ুরমুখী, কচু, হেলাঞ্চ, কলমিশাক, বউটুনি, পেপুল, আদা, হলুদ, ও ঝাল লাগিয়েছেন। বাড়িতে বিভিন্ন ধরনের ফলজ গাছ আম, জাম, কাঁঠাল, নারকেল, কলা, পেঁপে, ডালিম, ছবেদা, আনারস, পেযারা, কাঠবাদাম, বাতাবি লেবু, আমড়া, কদবেল, বেল সহ নানান ধরনের গাছ রয়েছে। কাঠ জাতীয় গাছ আছে মেহগনি, আকাশমনি, শিশু গাছ, খৈ, বাবলা ইত্যাদি। পুকুরে আছে নানান ধরনের মাছ। এছাড়াও বাড়ির নিচেয় বেড় পুকুরে স্থানীয় মাছ এবং লবণ পানির একটি ঘের আছে যেখানে নোনা পানির বিভিন্ন মাছ চাষ হয়।
অদিতি রানীর ফসল চাষের পাশাপাশি গবাদি পশু পালন করে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেন। বিয়ের পরে স্বামীর সংসারে এসে দেখেন যৌথ পরিবার। সকলেই কৃষি কাজের সাথে যুক্ত। নিজের ইচ্ছা থাকলেও যৌথ পরিবারে তেমন কিছূ করতে পারতেন না। এরপর নিজের সংসার আলাদা হয়ে গেলে স্বামীর সাথে পরিকল্পনা করে সংসারের চাকাকে কিভাবে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা করতে থাকেন এবং গবাদি পশু পালনসহ কৃষি কাজ করতে থাকেন। ছোট করে হাঁস-মুরগি নিয়ে শুরু করেন। এরপর হাঁস-মুরগি বিক্রি করে একটি ছাগল ক্রয় করেন। এভাবে কয়েক বছর যেতে না যেতে কয়েকটি ছাগল বিক্রি করে একটি গরু ক্রয় করেন। আর সেখান থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের গবাদি পশু সম্প্রসারণ করতে থাকেন।
বর্তমানে অদিতি রানীর বাড়িতে ৪টি গরু, ৯টি ছাগল,২৫ টি পাতিহাঁস, ২৬টি মেরিহাঁস, ৪টি রাজহাঁস, ২৩টি মুরগি, যা দিয়ে সংসারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে বড় একটি অংশ আয় হয়।
প্রতিমাসে হাঁস-মুরগি ও ডিম বিক্রি করে প্রায় আড়াই হাজার টাকা এবং একইভাবে বছরে ছাগল ছাগল বিক্রি করে প্রায় ৫০ হাজার এবং গরু বিক্রি করে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো আয় হয়। এছাড়াও সবজি চাষেও বছরে প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো আয় হয় তাঁর। গ্রামের অধিকাংশ পরিবার তার কাছ থেকে স্থানীয় হাঁস-মুরগি ও ডিম এবং ছাগল ক্রয় করেন।
অদিতি রানী বাড়িতে সব ধরনরে দেশীয় গবাদি পশু পালন করেন যেমন হাঁস (পাতি হাঁস, মেরী হাঁস, রাজ হাঁস), মুরগি (গলাছেলা, কবুতর, কাজলী), ছাগল ও গরু। হাঁস-মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের জন্য লোকায়ত পদ্ধতি হাজোল এবং ঝুড়ি ব্যবহার করেন। এছাড়াও জৈব পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদের জন্য ভার্মি কম্পোস্ট ও গর্ত কম্পোস্ট আছে। একই সাথে ফসলের পোকা দমেনর জন্য জৈব বালাইনাশক ও সেক্স ফেরোমন ফাঁদ প্রযুক্তি ব্যবহার করেন।
অদিতি রানী জানান, ‘আমার বাড়িটি ছোট জায়গাও কম কিন্তু সব জায়গা আমি ব্যবহার করি। এমন কোন ফাঁকা জায়গা পড়ে নেই আমার। সব জায়গায় কম বেশি করে নানান ধরনের ফসল আছে। সব সময় কোন না কোন কিছু আমার বাড়িতে থাকে। আমার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৪ জন। পরিবারের জন্য বাজার থেকে তেল ছাড়া তেমন কিছু কেনা লাগে না। বাড়িতে যে ফসল উৎপাদন হয় তা পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে ভালো একটি অংশ বিক্রি করতে পারি। আর একটি পরিবারের যত রকম পুষ্টি দরকার আমি মনে করি তার সব কিছু আমার বাড়িতে আছে। সবজি আছে, ফল আছে, অচাষকৃত উদ্ভিদ আছে, হাঁস-মুরগি আছে, গরুর দুধ আছে, পুকুর ও ঘেরে নানান ধরনের মাছ আছে। মাঠের জমিতে ধান, ডাল, সুর্যমুখী, সরিষা ও গম চাষ করি। সব কিছু মিলিয়ে আমার বাড়ি একটি পুষ্টি বাড়ি। আর আমাদের এ বাড়িই হলো খাদ্য ও পুষ্টির উৎস।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমি প্রতিবছর যে সব ফসল চাষাবাদ করি তার বীজ সংরক্ষণ রাখি। প্রতি মৌসুমের ১৫-২০ জনের মাঝে বীজ বিতরণ করি। এবং ভার্মি কম্পোস্ট ও হাজোল তৈরি ও ব্যবহার এবং বীজ সংরক্ষণ বিষয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ সহায়তা করি। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান আমার এ উদ্যোগ ও চর্চা দেখতে আসেন। এছাড়াও বারসিক সহাযতায় যে পুষ্টি ভিত্তিক ‘পুষ্টি ব্যাংক’ শত বাড়ি তৈরির কাজ চলমান রয়েছে সেখানে আমার বাড়িটিই যুক্ত হয়েছে। বারসিক থেকে শতবাড়ি উন্নয়নে ধারাবাহিক সহায়তা ও যোগাযোগ চলমান রয়েছে।’
অদিতি রানী বসতভিটায় মৌসুম ভিত্তিক বিভিন্ন ফসল উৎপাদনের পাশাপাশি গবাদীপশু পালনে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান এবং একজন সফল নারী। তার উদ্যোগ উপকূলীয় এলাকায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য একটি আদর্শ মডেল।