মানিকগঞ্জের ঘরে ঘরে চলছে পিঠা তৈরীর ধুম
মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক
পঞ্জিকার বর্ষসূচীতে শীত আসতে আরো দিন দশেক বাকি। কিন্তু প্রকৃতিতে এবার শীতের আগাম আর্বিভাব। আর শীত মানেই বাহারি স্বাদের পিঠা-পুলি। বাঙালির খাদ্য সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য স্মৃতির স্মারক শীতের পিঠা-পুলি। শীত এলেই যেন বেড়ে যায় হরেক পদের – সুস্বাদু পিঠার বাহারী আয়োজনের ব্যস্ততা। গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে ধুম পড়ে যায় পিঠা বানানোর। কুয়াশা মোড়ানো শীতের ভোর বা সন্ধ্যায় হিমেল হাওয়ায় ধোয়া উঠা ‘ভাপা’ পিঠার স্বাদ না নিলে যেন বাঙালির অতৃপ্তি কাটেই না। নিজেদের আদি ঐতিহ্য অব্যাহত রাখতে ঘিওর উপজেলাসহ মানিকগঞ্জের গ্রামের ঘরে ঘরে চলছে পিঠা তৈরী ও থাওয়ার ধুম। মেয়ে- জামাইসহ অন্যান্য দূরবর্তী আত্মীয়দের দাওয়াত করে পিঠা খাওয়ানোর রেওয়াজ মানিকগঞ্জের মানুষের বহু প্রাচীন। শুধু গ্রাম নয়, শহরের আনাচে কানাচে গড়ে ওঠা দোকানগুলোতেও কিন্তু পিঠা তৈরির ধুম পড়ে গেছে। ক্রেতাদের চাহিদার কারণেই বিভিন্ন জনবহুল স্থানে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা ভাপা পিঠার পাশাপাশি চিতই পিঠা, তেল পিঠার দোকান নিয়ে বসেছেন। শীতের সকাল কিংবা সন্ধ্যায় হাওয়ায় ভাসছে এসব পিঠার ঘ্রাণ।
একসময় প্রায় অর্ধশত রকমের পিঠার প্রচলন ছিল এখানে কিন্তু আধুনিকতার যাতাকলে আর রুচি পরিবর্তনের ফলে হারিয়ে গেছে অনেক পিঠার নাম। একেক অঞ্চলে রয়েছে একেক রকম পিঠা। রয়েছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। আবার একই পিঠা একেক এলাকায় একেক নামে পরিচিত। ভাপা পিঠা, নকশি পিঠা, চিতই পিঠা, দুধ পুলি, রস পিঠা, ডিম চিতই পিঠা, দোল পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা, তেল পিঠা, আন্দসা, কাটা পিঠা, ছিটা পিঠা, গোকুল পিঠা, চুটকি পিঠা, মুঠি পিঠা, জামদানি পিঠা, হাঁড়ি পিঠা, চাপড়ি পিঠা, পাতা পিঠা, বিবিখানা, সরভাজা, পানতোয়া, মালাই, ক্ষীরকুলি, লবঙ্গ লতিকা, ঝালপোয়া, ঝুরি, সূর্যমুখী, নারকেলি, সিদ্ধপুলি, ভাজা পুলি, দুধরাজ ইত্যাদি পিঠা তৈরী ও খাওয়ায় মানিকবাসীর জুড়ি মেলা ভার।
নয়া খেঁজুর গুড়, আর নতুন চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি হয় এসব পিঠা। গরম পানির ভাপে এ পিঠা তৈরি হয় বলে এর নাম হয়েছে ভাপা পিঠা। পিঠাকে মুখরোচক করতে গুড় আর নারিকেলের সাথে সামান্য পরিমাণ লবন মেশানো হয়। এতেই স্বাদ বাড়ে বলে জানিয়েছেন দোকানীরা।
এমন সময় গ্রামের প্রায় প্রতি বাড়িতে মেয়ে-জামাতা, বিয়াই-বিয়াইনসহ বিভিন্ন আত্মীয় স্বজন এবং দূর-দুরান্তে অবস্থান করা পরিবারের সদস্যদের মাঝে এক অঘোষিত পিঠার নিমন্ত্রণের রব পড়ে যায়। বানিয়াজুরীর রাথুরা গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ খাদিজা বেগম বলেন, “শীতের পিঠা খাওয়াতে মেয়ে ও জামাতাদের দাওয়াত করে এনেছি। দুই ছেলে চাকুরী ও পড়াশোনা সূত্রে ঢাকায় থাকে। তাদেরকেও ফোন করে বাড়িতে এনেছি। সবাই মিলে একসাথে পিঠা না খেতে পারলে মনটা কেমন জানি আনচান করে”।
রস পিঠা মানিকগঞ্জের স্থানীয় ভাষায় “ ভিজাইনা পিঠা” অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি পিঠা। পানি ও গুড় জাল দিয়ে তাতে দুধ মিশিয়ে আরও ৩০ মিনিট আগুনে রেখে সিরা তৈরী করতে হয়। এরপর চালের গুড়ায় তৈরী গোল ও লম্বাটে আকৃতির পিঠাগুলো সিরায় দিয়ে একবার বলক এলেই চামচ দিয়ে সাবধানে নেড়ে দিতে হয়। চুলা থেকে নামিয়ে সারা রাত এভাবেই ভিজিয়ে রেখে পরদিন সকালে পরিবেশন করা হয় আমন্ত্রিতদের মাঝে।
অনুরুপভাবে চালের গুড়ার আটা গুলিয়ে তাওয়ায় বসিয়ে দিয়ে তৈরি করা হয় মজাদার চিতই পিঠা। চাটনি, ধনে, কাঁচা মরিচ, সরিষা বাটা ও গুঁড় দিয়ে দোকানীরা পরিবেশন করেন বলে জানালেন মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের পিঠা বিক্রেতা সমেজ মিয়া। আকার এবং প্রকারন্তে প্রতিটি বিক্রি হয় ৫, ১০ ও ২০ টাকায়। তেল পিঠা তৈরিতে নতুন চালের গুঁড়া পানিতে গুলিয়ে তেলে ভেজে নিয়ে তৈরি করা হয় তেল পিঠা। কম পুঁজিতে যে কোন স্থানে সহজে বাজারজাত করা যায় বলে অনেক ক্ষুদ্র ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা এসব পিঠার দোকান করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।শীত আসে যেন মেলা বসে পিঠার, শীত যায় প্রতিক্ষায় থাকে আগামী শীতের। যতদিন প্রকৃতিতে শীত থাকবে ততদিন বাঙালির রসনা তৃপ্তিতে থাকবে এসব মজাদার পিঠার আয়োজন। এককথায় মানিকগঞ্জের ঘরে ঘরে এখন চলছে পিঠা তৈরীর ধুম।