চারুলতা: কৃষকের উদ্ভাবিত ধান
বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ বাস করেন সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলে। দেশের মোট ১৯টি উপকূলীয় জেলা ও ১৪৭টি উপজেলার মধ্যে ১২টি জেলার ৪৮টি উপজেলা সরাসরি সমুদ্রের মুখোমুখি অবস্থিত। আর বাকি ৯৯টি উপজেলা ভৌগোলিকভাবে অভ্যন্তরীণ উপকূলেরই অংশ যেখানে উপকূলীয় ভৌত পরিবেশ দৃশ্যমান। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যমনগর এমনই একটি উপজেলা যা সমুদ্রের মুখোমুখি অবস্থিত। এই উপজেলার চন্ডিপুর গ্রামের কৃষক তিন সন্তানের জনক কৃষক দিলিপ তরফদার (৪৫) নিরলস চেষ্টায় উদ্ভাবন করেছেন চারুলতা নামে লবণ সহনশীল আমন মৌসুমের জন্য একটি নতুন ধানজাত।
শ্যামনগর উপজেলার কৃষি দেশের অন্যান্য উপকূলীয় এলাকার মতোই নানা ধরণের প্রতিকূলতার সম্মুখীন। এখানকার কৃষিজমির ক্রমবর্ধিষ্ণু লবণাক্ততা, লবণসহিষ্ণু ফসলজাতের অভাব, অব্যবস্থাপনাগত কারণে কৃষিজমির উর্বরতা হ্রাস, অনিয়ন্ত্রিত পানি প্রবাহ, বছরের পর বছর একই ধরণের ফসলের চাষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে নানা ধরণের সমস্যা ক্রমশ বাড়ছে। ২২ বিঘা কৃষিজমির মালিক দিলিপ তরফদারও প্রতিনিয়ত নানা ধরণের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হন। এলাকায় ভূগর্ভস্থ পানির লবণাক্ততার জন্য বোরো মৌসুমে ধান চাষ করা যায় না। আর আমন মৌসুমে বিআর ১০, বিআর ২২ ও ব্রিধান ৪৯ জাতের চাষ করলেও দিলিপ তরফদার নানা ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। অধিকাংশ কৃষকের মতো দিলিপ তরফদারেরও পছন্দ রোগবালাই প্রতিরোধী, ভালো ফলন, চিকন ধান। অন্যদিকে বাজার থেকে কেনা বীজে অংকুরোদগম ভালো হয় না, অনেক সময় পর্যাপ্ত সার-কীটনাশক দিয়েও ভালো ফলন পাওয়া যায় না। দু’তিনবছর চাষ করার পর ঘরে সংরক্ষিত বীজের মান ভালো থাকে না। তিনি নিজেই বীজ সংরক্ষণ ও পছন্দসই বীজ উৎপাদনের কথা ভাবতে থাকেন।
দিলিপ তরফদার ২০০৯ সালে বারসিক’র সহায়তায় সংকরায়নের মাধ্যমে ধানজাত উন্নয়ন বিষয়ক ব্যবহারিক প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ পান। প্রশিক্ষণে তিনি প্রথম জানেন বিভিন্ন উদ্ভিদে ছড়িয়ে থাকা উত্তম ও কাংখিত বৈশিষ্ট্যসমূহ একটি উদ্ভিদে স্থানান্তরিত করে কাঙ্খিত বৈশিষ্ট্যের নুতন জাত তৈরি করা সম্ভব। বিষয়টি তাকে সংকরায়নের কাজে উদ্বুদ্ধ করে। তিনি ২০১০ সালে স্থানীয় ধানজাত খেজুরছড়ি এবং কুটেপাটনাই জাতের মধ্যে সংকরায়ন করেন। তিনি খেঁজুরছড়ি মা এবং কুটেপাটনাই বাবা জাত হিসাবে ব্যবহার করেন। সংকরায়নের ফলে সৃষ্ট প্রথম বংশধরের (F1মধ্যে দৃশ্যমান বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে পছন্দের বৈশিষ্টের ধারাবাহিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জাত উদ্ভাবনের কৌশলটি তিনি বর্তমানে ষষ্ঠ বংশধর (F6) পর্যন্ত অব্যহত রেখেছেন। খেঁজুরছড়ি ও কুটেপাটনাই জাতদুটি বাছাই করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “খেজুরছড়ি ধান দেখতে চিকন, মুড়ি ও চিড়া ভালো হয় এবং ভাত খেতে সুস্বাদু । অপরদিকে কুটেপাটনাই জাতটি লবণাক্ততা সহনশীল।
সংকরায়নের কৌশল জানতে চাইলে তিনি বলেন, ১/৩ অংশ বের হয়েছে এমন শীষসহ নির্বাচিত দু’টি জাতের একগোছা চারা কিবালের দিকে মাটিসহ তুলে পেনিক্যাল ইমাসকুলেশনের জন্য নির্বাচন করতে হয়। ইমাসকুলেশনের আগের দিন ধানের গোছাটি চারপাশের মাটি সমেত তুলে টবে বা দু’টি বালতির ভিতর আলাদাভাবে রাখতে হয়। জমিতে ধানের চারার গোড়ায় যে রকম পানি থাকে টবে বা বালতিতে তোলার পরও চারার গোড়ায় যেন পানি দেওয়ার জায়গা থাকে ও টবে পানি আটকে থাকে সেজন্য টবের বা বালতির তলায় ছিদ্র থাকলে তা বন্ধ করে নিতে হবে।” তিনি বলেন, “মাতৃগাছের শীষের তিনভাগের একভাগ বের হয়েছে এমন একটি শীষ নির্বাচন করা করতে হয়। শীষের মাঝামাঝি স্থানের ১৫-২০টি দানার ভেতর থেকে পূংকেশর নিডল ও কাঁচির মাধ্যমে বের করে নিতে হয় (এমাসকুলেট)। এরপর শীষটি কাগজের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে রেখে পরদিন বেলা ১০-১১ টার মধ্যে পিতৃগাছের শীষ মা গাছের (এমাসকুলেট করা) শীষের উপর ঝাঁকিয়ে পরাগায়ন করতে হয়। পরপর দুদিন একই কাজ করি। পরাগায়নের পরই কাগজের প্যাকেট দিয়ে শীষটি ঢেকে দিই।” তিনি আরও বলেন, “এরপর ছয় সাতদিন পর প্যাকেট খুলে দেখি ধানের মধ্য সবুজ চাল তৈরি হচ্ছে। এরপর আবারো কাগজের প্যাকেট দিয়ে ঢেকে সাবধানতার সাথে রাখি। চাল পুষ্ট হলে সাবধানে তা সংগ্রহ করে হালকা রোদে শুকিয়ে কৌটার মধ্য রেখে দেই। পরবর্তী মৌসুমে ভেজা টিস্যু পেপারের উপর রেখে চাল গজাই এবং পটে কাদা মাটিতে চারা রোপণ করি। এ থেকে যে গাছ হয় সেখান থেকে বীজ সংগ্রহ করে পরের বছর জন্মাই।” এ বীজের গাছ হলে পছন্দের বৈশিষ্ট্যগুলো থেকে বীজ নিয়ে পরের মৌসুমে চাষ করি। এভাবে ধারাবাহিকভাবে বর্তমানে ষষ্ঠ বছরের নির্বাচন কাজ চলছে বলে তিনি জানান।
তিনি জানান, সংকরায়ন করার সময় এমাসকুলেশন (ফুলের পুরুষ অংশ অপসারণ) বেশি সতর্কতার সাথে করতে হয়। ধানের গর্ভাশয় নষ্ট হয়ে গেলে পরাগায়ন ঠিক মতো হবে না বলে তিনি জানান। ধান গাছের গোড়ায় যেন পর্যাপ্ত পানি থাকে, শুকিয়ে না যায় তা খেয়াল রাখতে হবে। তার উদ্ভাবিত চারুলতা ধানের বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলেন, “চারুলতা ধানের আগায় হালকা কালো দাগ আছে। আকৃতিতে খানিকটা বিআর২২ জাতের মতই তবে শীষের বৈশিষ্ট্য আলাদা। শীষ তুলনামূলক লম্বা ও শীষের ধানের সংখ্যা বেশি।” উদ্ভাবিত জাতের পছন্দনীয় বৈশিষ্ট্যগুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, “১৫০ থেকে ১৫৫ দিন জীবন দৈর্ঘ্যরে চারুলতা ধানটির শীষ অনেক বড়, ধানটিতে রোগ-পোকামাকড় আক্রমণ খুবই কম। গুড়া পোকা (প্লান্ট হপার) আক্রমণ করে না। তবে খুব কম মাত্রায় মাজরা পোকা ও ধান ফোটা (ফলস স্মার্ট) রোগ হয়। জাতটির গাছ শক্ত, বাতাসে সহজে হেলে পড়ে না, শীষের গাঁথুনি খুব ঘন হয়, সরু চাল, ফলন মা-বাবার থেকে অনেক বেশি। ধানের চাল গন্ধহীন, সাদা, ভাত খেতে সুস্বাদু। জলাবদ্ধতা সহনশীল ও বিঘা প্রতি ধানের উৎপাদন শুষ্ক অবস্থায় প্রায় ২১ মণ। বর্তমানে তিনি এক বিঘা জমির প্লটে চারুলতা ধানটির ষষ্ঠ (F6) প্রজন্মের পরীক্ষণ করছেন। তিনি জানান, এ পর্যন্ত বড়কুপোট, কাছড়াহাটি ও হাটছোলা গ্রামের তিনজন কৃষক প্রায় ৫বিঘা জমিতে চারুলতা ধান চাষ করছেন। এ ধান সম্পর্কে কৃষকরা বলেছেন, এই জাতের গাছ শক্ত, শীষ লম্বা, ফলন ভালো, জলাবদ্ধ জায়গায় লাগানো যায়, ভাত ক্ষেতে সুস্বাদু, সার-বিষ কম দিয়েও উৎপাদন করা যায়। জাতটির নামকরণ সম্পর্কে দিলিপ তরফদার বলেন, “আমার বড়মা (যিনি তাকে লালন পালন করেছেন) এর নামে ধানটির নাম রেখেছি ”চারুলতা” ।
কৃষি উদ্ভাবনী কৃষিকাজের জন্য শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন দিলিপ তরফদারকে স্বাধীনতা সম্মাননা-২০১৬ প্রদান করেন। বর্তমানে ধানজাতটি তিনি আগ্রহী কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান। জাত উদ্ভাবনের কাজটি করতে পেরে তিনি আনন্দিত এবং তার সামাজিক সম্মান বেড়েছে বলে দিলিপ তরফদার মনে করেন। স্থানীয় কৃষকরা যখন তার উদ্ভাবিত ধানের প্রশংসা করে ও ধানটির নানা দিক সম্পর্কে জানতে চায় তখন তিনি আগ্রহসহকারে জানান। এ ধরণের প্রশংসা তাকে অনুপ্রেরণা যোগায় এবং নিজের কাজ অন্য কেউ মূল্যায়ন করছে দেখেও তিনি খুব আনন্দিত হন।
শফিকুল ইসলাম ওয়ারেস (বরগুণা) এবং সুশান্ত মন্ডল ও পার্থ সারথী পাল (সাতক্ষীরা) এর সহায়তায় প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন এবিএম তৌহিদুল আলম