ভাষা শহীদ রফিক এর স্মৃতি রক্ষার্থে চাই সম্মিলিত উদ্যোগ
মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক:
‘ভাষা আন্দোলন’ বাংলা ও বাঙালির এক ঐতিহাসিক পটভূমি। ১৯৫২ সালে বাংলার অকুতোভয় ভাষা সৈনিক দামাল ছেলেরা বুকের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করে সৃষ্টি করেছিল এক বিরল ইতিহাসের। সেই দিন যে সন্তানেরা- মা, মাতৃভাষার নাড়ির অবিচ্ছেদ্য সর্ম্পকের টানে জীবন দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতিকে করেছেন গৌরবান্বিত। তাঁদেরই একজন ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ। ১৯৫২ থেকে ২০১৭; পেরিয়ে গেছে কয়েক’টি যুগ। কিন্তু আজো তাঁর স্মৃতি রক্ষায় ও সংরক্ষণের নেই তেমন কোন উদ্যোগ।
ভাষা আন্দোলন ও রফিক
১৯৪৮ সালের ২১মার্চ ও ২২মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের বিশেষ সমাবর্তন এবং রেসকোর্স মাঠে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনায় দেয়া মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ’র ভাষণকে উদ্ধৃত করে দৈনিক আজাদ পত্রিকা ২৪ এবং ২৬ মার্চের সংখ্যায় জানায়, “আমি আপনাদিগকে সুস্পষ্ট ভাবে বলিতে চাই যে, উর্দুই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে, অন্য কোন ভাষা নহে। যে কেহ অন্যপথে চালিত হইবে সেই পাকিস্তানের শত্রু।” জিন্নাহ’র এই উক্তির বিরুদ্ধে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা অমিত শক্তি নিয়ে রুখে দাঁড়ায়। অনন্ত ভালোবাসায় আগলে রাখে মায়ের ভাষা বাংলাকে। রাজপথ ও জনপদে ঝড়ের মত জেগে ওঠা প্রচন্ড প্রাণাবেগে ভেসে যায় জিন্নাহ’র দম্ভোক্তি এবং বাঙালিকে পদানত রাখার বাসনা। ১৯৫২’র ২১ ফেব্রুয়ারি রফিক-সালাম-জব্বার-বরকতের মত সূর্য সন্তানদের রক্তের বিনিময়ে জেগে ওঠে ৫৬ হাজার বর্গমাইল। প্রাণের দাবি ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ হয়ে উঠে স্বাধীনতার বীজ বপনের সূতিকাগার। অনেক ত্যাগ আর চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে ১৯৫৬’র ২৯ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তান গণপরিষদে সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ২১৪ অনুচ্ছেদে স্বীকার করে নেয়া হয়, “THE STATE LANGUAGES SHALL BE URDU AND BENGALI”। ভাষার লড়াই ছিল বাংলা এবং বাঙালীর প্রথম সার্থক লড়াই। আর এই লড়াই ও বিজয়ের এক মহানায়ক মানিকগঞ্জের শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ ।
শহীদ রফিকের বাড়ি
উত্তর-পূর্বে ধলেশ্বরী আর দক্ষিণ-পশ্চিমে কালীগঙ্গা। এরই মাঝে এক সবুজ জনপদ মানিকগঞ্জের সিংগাইর। উপজেলায় ১১ টি ইউনিয়নের একটি বলধারা। এ ইউনিয়নের প্রাচীন গ্রাম ‘পারিল’। এখানেই জন্ম হিরন্ময় দ্যুতিতে উজ্জ্বল এক মহামানব, আমাদের অহংকার ভাষা শহীদ রফিকের।
এ গাঁয়ের ইতিহাসও বেশ সমৃদ্ধ। ড. মুহাম্মদ এনামুল হক তাঁর ‘মুসলিম বাংলা সাহিত্যে’ বলেছেন- “ত্রয়োদশ শতকের দ্বিতীয় দশকে পারিলে খানকা প্রতিষ্ঠা করে ধর্ম প্রচার করেন সুফী সাধক গাজীমুলক ইকরাম খান।” ১৮৭৩ সালে এ গ্রাম থেকেই আনিস উদ্দিন আহমেদ “পারিল বার্তাবহ” নামে পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। ’৬৯ এর গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছিলেন এই গ্রামেরই আরেক বীর সন্তান ‘এছহাক’।
রফিকের বংশপরিচয় ও শিক্ষা জীবন
১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর জন্ম গ্রহণ করেন ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ। রফিকের দাদার নাম মো. মকিম। বাবা আব্দুল লতিফ এবং মা রাফিজা খাতুন। তাঁর পিতা আবদুল লতিফ ছিলেন ব্যবসায়ী- কলকাতায় ব্যবসা করতেন। রফিকরা ছিল পাঁচ ভাই ও দুই বোন। ভাইদের মধ্যে রফিক ছিল সবার বড়। অন্য চার ভাই হলেন- ১. আবদুর রশীদ (১৯৩১-১৯৮৭), ২. আবদুল খালেক (১৯৩৪-), ৩. বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুস সালাম (১৯৪৩-১৯৭২), ৪. খোরশেদ আলম (১৯৪৭-) এবং বোন ১. আলেয়া বেগম (১৯৩৮-) ও ২. জাহানারা বেগম (১৯৪৫-)। শৈশবে গ্রামের স্কুলেই তিনি লেখাপড়া করেন। মরহুম আশরাফ উদ্দিন চৌধুরী ও বীরেন্দ্রমোহন দত্তগুপ্ত শিক্ষকদ্বয়ের সুযোগ্য ছাত্র হিসাবে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেন। বাল্যকাল থেকেই রফিক ছিলেন চঞ্চল ও প্রাণোচ্ছ্বল। সাহিত্যাঙ্গনে ছড়া রচনায় পটু ছিলেন। কৈশোর বয়সেই সুঁই-সুতায় নকশা আঁকায় হাত ছিল বেশ দক্ষ। ছিল গাছে চড়ার প্রচন্ড শখ। গাছে চড়তে গিয়ে তো একবার তার পা ভাঙে। চিকিৎসার জন্য সে সময় তাঁকে কলকাতা পর্যন্ত পাঠানো হয়েছিল। চঞ্চল রফিকের ভবিষ্যত ভেবে তার বাবা তাঁকে কলিকাতার মিত্র ইন্সটিটিউটে ভর্তি করিয়ে দেন। কিন্তু সেখানে তাঁর মন টেকে নি। ক’বছর পর ফিরে আসেন দেশে। ভর্তি করিয়ে দেয়া হয় সিংগাইরের বায়রা হাই স্কুলে। এ স্কুল থেকেই ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি। এরপর ভর্তি হন দেবেন্দ্র কলেজের বাণিজ্য বিভাগে এবং ১ম ও ২য় বর্ষ পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তারপর লেখাপড়া বিরতি। ঢাকার বাবু বাজারে আকমল খাঁ রোডে পিতার সঙ্গে ‘পারিল প্রিন্টিং প্রেস’ নামে ছাপাখানা পরিচালনা শুরু করেন। পরে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে (বর্তমান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন। জগন্নাথ কলেজের ছাত্র থাকা কালেই শাহাদাৎ বরণ করেন তিনি।
কোথায়, কিভাবে শহীদ হন রফিক?
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, মামাতো ভাই মোশাররফ হোসেনের সাথে লক্ষ্মীবাজারের দিকে যাওয়ার পথে মেডিকেল কলেজের গেটের কাছে এলে পুলিশ তাঁদের উত্তর দিকে যেতে বাঁধা দেয়। তখন তাঁরা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গনের মধ্যদিয়ে লক্ষ্মীবাজারের দিকে রওনা দেন এবং মেডিকেল কলেজ হোস্টেলের উত্তর পশ্চিম দিকের গেটের নিকট পৌঁছান। সেখানেও একদল বন্দুকধারী পুলিশকে দেখতে পান তাঁরা। তখন মোশাররফ হোসেন হোস্টেলের ১৩ ও ১৯ নং শেডের পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে একজনের সাথে কথা বলতে থাকেন। রফিক তখন দাঁড়িয়ে ছিলেন ২২ নম্বর শেডের কাছে। কিছুক্ষণ পরই একদল পুলিশ হোস্টেলে প্রবেশ করেই গুলিবর্ষণ শুরু করে। এদের গুলিতে হোস্টেলের বারান্দাতেই নিহত হন রফিক। এ তথ্যগুলো গবেষক বশীর আল হেলাল তাঁর ‘ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। যা শহীদ রফিক হত্যা মামলা থেকে নেয়া।
ভাষা আন্দেলনের প্রথম শহীদ
শতভাগ না হলেও এটা মোটামুটি নিশ্চিত যে, রফিকই ছিলেন ৫২’র ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। বিভিন্ন উৎস থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা গেছে যে, যিনি ভাষা আন্দোলনে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন। ১৯৫২’র ২২ ফেব্রুয়ারি সংখ্যার দৈনিক আজাদ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল,“গতকল্য (বৃহস্পতিবার) বিকাল প্রায় ৪ টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে বিক্ষোভরত ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলি চালনার ফলে বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের পুত্র রফিকুদ্দিন আহমদের মৃত্যু হয়।” সাপ্তাহিক ‘নতুন দিন’ পত্রিকা তাদের ২য় বর্ষ ১৬-১৭শ সংখ্যায় দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সৌজন্যে শহীদ রফিকের মাথার খুলি উড়ে যাওয়া ছবি ছাপে। বিশিষ্ট গবেষক ও সাহিত্যিক বশীর আল হেলাল তাঁর ‘ভাষা আন্দেলনের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেছেন, “হয়তো রফিক উদ্দিন আহমদ প্রথম শহীদ হন।” এ গ্রন্থে তিনি তথ্য-উপাত্ত-যুক্তি দিয়ে রফিককেই প্রথম ভাষা শহীদ হিসাবে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। ‘ভাষা আন্দোলন ও শহীদ মিনার’ গ্রন্থে ড. রফিকুল ইসলাম ভাষা আন্দোলন কালে ঢাকায় অবস্থানরত শহীদ রফিকের ভগ্নিপতি মোবারক আলী খানের যে বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন তাতেও প্রমাণিত হয় সেইই ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ।
রফিকের লাশ ও কবর
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শহীদ রফিকের মৃতদেহ সনাক্ত করেন তাঁর ভগ্নিপতি মোবারক আলী খান। সময় ছিল রাত ৯ টার মত। সে সময় রফিকের পরনে ছিল হালকা নীল রঙের সার্ট, শাদা ফুলপ্যান্ট, নেভী ব্লু রঙের মোজা, চকচকে কালি করা পুরনো ইংলিশ সু। আর ছিল একটি সেফার্স কলম। যে কলম দিয়ে মোবারক আলী খান নিজেও বহুবার লিখেছেন। প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট ওবায়দুল্লাহ’র উপস্থিতিতে শহীদ রফিকের জানাজা পড়ান হাফেজ আব্দুল গফুর। তাঁকে কবর দেয়া হয় আজিমপুর কবর স্থানে রাত তিনটায়। পাকিস্তানি পুলিশ নিজেরাই লাশ কবরস্থ করেছিল। আজিমপুর কবরস্থানের অসংরক্ষিত এলাকায় লাশ দাফনের কারনে আজো অজ্ঞাত রয়ে গেছে তাঁর কবর। শহীদ জননী রফিক এর মা তাঁর জীবদ্দশায় একটি বারের জন্যও প্রিয়পুত্রের কবরটি দেখে যেতে পারেন নি।
শহীদ রফিক হত্যা মামলা
১৯৫২ সালের ২৮ মার্চ রফিকের মামাতো ভাই মোশাররফ হোসেন খান ঢাকার সদর মহকুমা হাকিম এন. আহমদের এজলাসে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু বিচারক ফৌজদারী দন্ড বিধির ১৩৭ এবং ১৩২ ধারার কথা বলে মামলা গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করেন ।
বিয়ের পিঁড়িতে বসা হয়নি
১৯৫১ সালের নভেম্বরে নিজ গ্রাম পারিলের নাসির উদ্দিনের মেয়ে পানু বিবির সাথে রফিকের বিয়ের কথা পাকা হয়। বাবা মায়ের অনুরোধে এ সময় ও বয়সে বিয়েতে রাজি হন তিনি। ৫২’র ফেব্রুয়ারিতে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করবার জন্য রফিকের বাবা কর্মস্থল ঢাকা থেকে গ্রামের বাড়ি যান। কিন্তু বিয়ের তার আগেই শাহাদাৎ বরণ করেন রফিক। বিয়ের পিঁড়িতে বসা আর হয়ে উঠেনি তাঁর।
শহীদ রফিক গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর
প্রয়াত সংসদ সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী শামসুল ইসলাম খানের সার্বিক সহযোগিতায় ও সে সময়ের উপজেলা নির্বাহী অফিসার আশরাফ আলীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৯৫ সালে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে সিঙ্গাইর উপজেলা চত্বরে টিনের ঘরে রফিক স্মৃতি পাঠাগারের কার্যক্রম চালু করা হয়। দীর্ঘদিনের নাজুক অবস্থা কাটিয়ে পাঠাগারে নিজস্ব তহবিলের ৩ লাখ টাকা ও সরকারি অনুদান দিয়ে ২০০৬ সালে সে সময়ের উপজেলা নির্বাহী অফিসার দেলোয়ার হোসেন উপজেলা চত্বরে পাঠাগারের একতলা পাকা ভবন নির্মাণ করেন। ২০০৮ সালের ১৫ মে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিক্রমে ভাষা সৈনিক রফিক উদ্দিন আহমদের স্মৃতিকে চিরজাগ্রত রাখতে তাঁর জন্মস্থান সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের ‘পারিল’ গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রফিকনগর নামকরণ করা হয়েছে এবং সেখানে এক বিঘা জায়গার ওপরে গড়ে উঠেছে শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। উল্লেখ্য, এই এক বিঘা জায়গাটি দান করেন লে. কর্নেল (অব.) মজিবুল ইসলাম (পাশা)। জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং উদ্যোগ গ্রহণ করেন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল। বেসরকারি সংস্থা প্রশিকা শহীদ রফিক জাদুঘর স্থাপন করে ভাষা শহীদ রর্ফিকের নিজ বাসভবনে। রফিকের বেশকিছু দূর্লভ ছবি রয়েছে এখানে। এছাড়া বাংলা একাডেমি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং প্রশিকাসহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে দেওয়া ১১০০০ মতো বই রয়েছে এ জাদুঘরে।
কেমন আছে ভাষা শহীদ রফিকের পরিবার
বাড়ির ঐতিহ্য রক্ষা করতে শহীদ রফিকের ছোট ভাই মৃত আব্দুল খালেকের স্ত্রী গোলেনূর বেগম (৭০) বসবাস করছেন এখানে। আলাপকালে তিনি বলেন, “এই বাড়ির স্মৃতি রক্ষায় আমাকে এখানে থাকতে হচ্ছে। দেশ-বিদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে যেসব মানুষ এসে শহীদ রফিক সম্পর্কে তথ্য চাচ্ছেন তা দিতে দিতেই আমি ক্লান্ত।” তিনি আরো বলেন, “রফিকের একমাত্র জীবিত ভাই খোরশেদ আলম মানিকগঞ্জ সদরে সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত বাড়িতে থাকেন। বছরে সরকারিভাবে বরাদ্দ ৬০ হাজার টাকা ভাতা তিনিই নেন। কিন্তু আমি আজ অসুস্থ্য। সবাই আসেন সাহায্যের আশ্বাস নিয়ে। কেউ আমাদের খবর রাখেন না। শুধু ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমাদের কথা মনে পড়ে।” রফিকের ছোট ভাইয়ের ছেলে শাহজালাল ওরফে বাবু তার স্ত্রী ও গোলেনূর বেগম আছেন এই বাড়িতে।
সিংঙ্গাইরের চারিগ্রাম এলাকার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্র উজ্জ্বল হোসাইন জানান, “এ পাঠাগারে অনেক বই আছে। প্রতিদিন বিভিন্ন এলাকার অনেক মানুষ আসে এই জাদুঘর দেখতে। তবে এ জাদুঘরে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সমৃদ্ধ বইয়ের সংখ্যা খুবই কম; যা সত্যিই দুঃখজনক।” পারিল গ্রামের মোঃ ফিরোজ, বায়রা এলাকার দেওয়ান সাদ্দাম হোসেনসহ আরো অনেকেই বললেন, “ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ রফিক দেশের গর্ব-সম্মানের বীর।” এসময় তারা দাবি করে জানান, “রফিক উদ্দিন স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারে শহীদ রফিকের ব্যবহৃত সামগ্রী রাখা হোক। এর মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনে এই অগ্রনায়কের সর্ম্পকে আরো ভালোভাবে জানতে পারবে।”
এ বিষয়ে মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোকেট গোলাম মহিউদ্দিন বলেন, “সরকার শহীদ রফিকের নামে তার নিজ গ্রামে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তার বসতবাড়িতে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনসহ গুরুত্বপূর্ণ আরো বই যেন পর্যাপ্ত থাকে, সে বিষয়ে অবশ্যই জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।”
শহীদ রফিক জাদুঘরে যাবেন যেভাবে
ঢাকা থেকে বাস যোগে মানিকগঞ্জ কিংবা হেমায়েতপুর হয়ে সিংগাইরের ঋষিপাড়া মোড়। এরপর অটো, সিএনজি, রিকশা বা মোটর সাইকেল যোগে সরাসরি পারিল (রফিক নগর) গ্রামে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস চালু হয়েছে ২০০০ সাল হতে। ১৯৯৯ সালে ১৭ নভেম্বরে ইউনেস্কোর সাধারন কনফারেন্সে সবসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় ২১ এ ফেব্রুয়ারিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে ঘোষণার। এই ঘোষণার ফলে একুশের গৌরবোজ্জল ইতিহাস ছড়িয়ে পরেছে বিশ্ব দরবারে। জাতিসংঘের ১৮৮টি সদস্য দেশেও উদযাপিত হয়ে থাকে এই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস।
কালের খড়গ পেড়িয়ে এখনো তাঁর পরিবারের কাছে টিকে আছে শহীদ রফিকের গায়ের পাঞ্জাবী, পড়নের লুঙ্গি। স্মৃতির সুগন্ধি জড়ানো এই লুঙ্গি-পাঞ্জাবী এক সময় হারিয়ে যাবে সময়ের গোধুলী লগ্নে। কিন্তু রফিক নামের অণির্বান দ্বীপশিখা জ্বলবে বাঙালীর বর্ণমালায়, বাউলের সুরে-সুরে, হিজল-তমাল- কৃষ্ণচূড়ার রক্তিম আভায়। বিশ্ব স্মরণ করবে তাদের; জাতি শ্রদ্ধাভরে গর্ব করবে চিরকাল।