“কম্পিউটার আপা” লিপির সফল হয়ে উঠার গল্প
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
নারীদের পিছিয়ে থাকার সময় শেষ হয়েছে অনেক আগেই। কর্মক্ষেত্রে নারীর অগ্রযাত্রা আজ উজ্জল-দৃশ্যমান। বিমানের পাইলট থেকে জাতীয় সংসদের স্পিকার, খেলার মাঠ থেকে বিজ্ঞান, চাকুরি থেকে সাহিত্য সকল ক্ষেত্রে নারীদের জয়জয়কার। কিন্তু এর মাঝেও রয়েছে হাজারো বৈষম্যের কন্টকময় শক্ত দেয়াল। এই বৈষম্যের দেয়াল মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে আসার গল্পটা নিতান্তই সাদামাটা নয়; অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা, অনেক প্রতিকূলতা আর অনেক শ্রমের সমন্বয়ের মিশ্রণে গড়া গল্প। তেমনি এক কাহিনীর মূল চরিত্রের নাম ফারহানা আফরোজ লিপি। গ্রামীণ কুসংস্কার আর প্রতিবন্ধকতাকে পেছনে ফেলে নিজেকে সফল উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার প্রত্যন্ত জোকা গ্রামের লিপি। কেবল সংসারের হাল টেনে ধরা মেয়ে কিংবা সফল স্ত্রী নন, তীব্র ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম আর একাগ্র নিষ্ঠায় নিজ পরিচয়ে লিপি এখন ঢাকা বিভাগের অন্যতম সফল তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষক ও দক্ষ জনশক্তি তৈরির কারিগর।
শুরুর কথা
এসএসসি পাশ করে সবেমাত্র কলেজে পা রেখেছেন চঞ্চলা তরুণী লিপি। পরিবারের সবার সঙ্গে উচ্ছাস-আনন্দেই কাটছিল দিন। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম; ৬ সদস্যের পরিবারের একমাত্র উর্পাজনক্ষম ব্যক্তি তার বাবা মো. আনোয়ার হোসেন হঠাৎ একদিন মারা গেলেন। অস্বচ্ছলতা ও হতাশা নেমে এলো পরিবারটিতে। অর্থকষ্টে দু’বেলা দু’মুঠো খাদ্য যোগানই সেসময় পরিণত হলো অনিয়মিত রুটিনে। তখন লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া লিপির জন্য কতটা যে দুরূহ বিষয় হয়ে দাঁড়াল, তা বর্ণনাতীত কান্নাজড়ানো কন্ঠে বললেন তার মা রোকেয়া আনোয়ার । না, তবু হাল ছাড়েননি তিনি, চিরায়ত রীতিতে ভাগ্যের হাতে নিজেকে সোপর্দ না করে সামনে এগিয়ে যাবার দৃঢ় প্রত্যয়ের বীজ বুনলেন অন্তরে। তার সেই আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রমই তার গলায় দিয়েছে সাফল্যের বিজয় মুকুট।
দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে লিপি সেজ। বাবার রেখে যাওয়া সামান্য কিছু টাকা ছিল। তা দিয়ে বড় বোনের বিয়ে দেওয়া হয়। প্রয়োজনের তাগিদে তিনি প্রাইভেট পড়িয়ে কোন রকমে চালিয়ে যান নিজের পড়াশোনা। কিন্তু সংসার আর ছোট ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চলবে কিভাবে? মাথায় চিন্তা এলো, কিছু একটা করা দরকার। সিদ্ধান্ত নিলেন, গ্রামের আর দশজন গৃহবধূদের সাথে জামা/পাঞ্জাবী সেলাইয়ের কাজ করবেন। যেই ভাবা, সেই কাজ। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় (এনজিও) সেলাইয়ের কাজও মিলে গেল। কিন্তু সমস্যা হলো ঈদ কিংবা পূজার উৎসবের আগে তিন মাস ছাড়া বাকি সময় কাজ থাকে না। এতে তো সংসার চলবে না। নতুন দুশ্চিন্তার কালো মেঘ ভর করলো স্বপ্নীল হৃদয়ে। অবশেষে তাঁর এক আত্মীয়ের সহায়তায় কাজ নিলেন স্থানীয় এক দর্জির দোকানে। কাজের ফাঁকে চালিয়ে যান পড়াশোনা। মানিকগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজ থেকে সম্পন্ন করেন স্নাতক।
সাফল্যের গোড়াপত্তন
২০০৩ সালের কথা। লিপি একদিন মানিকগঞ্জ পৌর সুপার মার্কেটে ‘‘বিট-বাইট কম্পিউটার সেন্টার’’ নামে একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দেখতে পান। সে সময় ছোট্ট এই জেলা শহরে হাতে গোনা মাত্র দু-তিনটি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল। ওই কেন্দ্রে ক’য়েকজন শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল। লিপি তখন সাহস করে কথা বলেন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের স্বত্তাধীকারী বর্তমানে মোহনা টেলিভিশনের মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি মো. সালাউদ্দিন রিপনের সাথে। কম্পিউটার শেখার আগ্রহের কথা জানালেন লিপি এবং খুলে বললেন তার জীবনের সব ঘটনা। সবকিছু জানার পর টাকা ছাড়াই কম্পিউটার শেখানোর প্রতিশ্রুতি দিলেন রিপন।
বাড়ি ফিরে লিপি মা ও ছোট ভাই কে জানালেন তার ইচ্ছার কথা। পরের দিন থেকেই শুরু করলেন কম্পিউটার প্রশিক্ষণ নেওয়া। একই সঙ্গেই চলতে থাকল সেলাই কাজ আর কম্পিউটার প্রশিক্ষণ। এভাবে ছয় মাস না যেতেই মাইক্রোসফট ওয়ার্ড, এক্সেল, ফটোশপসহ কম্পিউটারের আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রোগ্রামিং সফটওয়্যারের কাজ সম্পর্কে ভালো ধারণা হলো তার। একসময় রিপন জানালেন, নানা কাজে তাঁর বাইরে থাকতে হয়। খুব একটা সময় দিতে পারেন না। তা ছাড়া প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আরও একজন প্রশিক্ষকেরও প্রয়োজন আপনি থাকবেন কি না? লিপি আর সুযোগটি হাতছাড়া করলেন না। তখনই তিনি রাজি হয়ে গেলেন। এবার লিপির সুযোগ হলো প্রশিক্ষণ নেওয়ার পাশাপাশি ‘‘বিট-বাইট কম্পিউটার সেন্টারে’’র প্রশিক্ষক হওয়ার। অপরদিকে বন্দোবস্ত হলো পারিশ্রামিক হিসেবে মাসে দুই হাজার টাকা। ফলে বাদ দিলেন সেলাইয়ের কাজ। আরও মাস ছয়েক পার হবার পর বেতন বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াল তিন হাজার টাকায়। এভাবে প্রশিক্ষণের চাকুরি কেটে গেল কয়েকবছর।
আত্মনির্ভরতার বুনিয়াদ
এবার লিপির মনে ভাবনার উদয় হলো, নিজেই একটা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দিলে কেমন হয়? বড় ভাইয়ের কাছে পরামর্শ নিলেন। ততদিনে বড় ভাইও পেয়ে গেছেন ভালো একটা চাকুরি। বোনের ইচ্ছার কথা জানার পর ভাই একটি কম্পিউটার কিনে দেওয়ার কথা জানালেন। কিন্তু প্রশিক্ষণ কেন্দ্র দিতে গেলে তো শুধু কম্পিউটার হলেই হবেনা। এর জন্য চাই একট ভালো ঘর, প্রয়োজনীয় উপকরণ ও আসবাবপত্র। গেলেন পৌর মার্কেটের বণিক সমিতির সভাপতি গোলাম কিবরিয়ার কাছে। ইতিমধ্যে একই মার্কেটে প্রশিক্ষণের কাজ করার সুবাদে আগে থেকেই লিপির সম্পর্কে জানতেন তিনি। ২০০৯ সালের মার্চ মাসের কথা। শেষমেশ তিনি জামানতের অগ্রিম টাকা ছাড়াই মাসে এক হাজার টাকা ভাড়ায় একটি দোকানের ব্যবস্থা করে দিলেন। এরপর একটি কম্পিউটার নিয়ে শুরু হলো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের কার্যক্রম। শুরুতে এসএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে এমন দুজন প্রশিক্ষণার্থী ভর্তি করা হলো। শুরু হলো লিপির নতুন করে স্বপ্ন দেখার, নতুন করে বাঁচার। প্রশিক্ষণ কেন্দ্রটির নাম দিলেন ’লিপি কাম্পউটার সেন্টার’। শুরুতে মার্কেটের আশপাশের ব্যবসায়ীরা বিষয়টি খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন না। এতে তিনি বিচলিত কিংবা পিছু হটেনি। বরং নতুন উদ্যোমে মনোনিবেশ করলেন কাজে। এক মাস দুই মাস-এভাবে বাড়তে থাকল প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা। তবে পড়ালেখা ছাড়েননি তিনি। এরই মাঝে মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ফেললেন। মাঝে বিয়েও করেন। বিয়ের পর থেকে তাঁকে সহযোগিতা করছেন স্বামী রকিবুল হাসান পাভেল। তিনি যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, মানিকগঞ্জ জেলা কার্যালয় থেকে কম্পিউটার বেসিক, পোষাক তৈরি ও মৎস চাষের উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ঋণ নিয়ে সফল আত্মকর্মী হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমানে তাঁর প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১৫টি কম্পিউটার, রয়েছে একশ’র ওপরে প্রশিক্ষণার্থী। মার্কেটের ব্যবসায়ীরা সবাই এখন তাঁকে সম্মান করেন। ডাকেন “কম্পিউটার আপা” বলে। তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রায় সহস্রাধিক নারী-পুরুষ বিভিন্ন পেশায় কম্পিউটার বিভাগে দায়িত্ব পালন করছেন।
প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির সমীকরণ
২০১১ সালে ২৮ অক্টোবর ঢাকায় ইনষ্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ভবনে ’ওয়াল্ড আইসিটি গোল্ড মেডেল অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ঢাকা বিভাগের শতাধিক অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষণ ও দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বিশেষ অবদানের কারণে লিপি কম্পিউটার সেন্টার প্রথম হওয়ায় ওই অনুষ্ঠানে তাঁকে স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি ফাউন্ডেশন ‘আইসিটি শ্রেষ্ঠ উদ্যেক্তা’র সম্মাননা স্মারক হিসেবে ক্রেস্ট ও স্বর্ণপদক প্রদান করা হয় তাঁকে।
জীবন সংগ্রামে জয়ী ফারহানা আফরোজ লিপি বললেন, “আমি সব সময় হৃদয়ে ধারণ করি “সাফল্য তাদের কাছেই ধরা দেয় যারা সাহস করে এগিয়ে যায়”। বাংলাদেশের নারী সমাজ দীর্ঘকাল থেকেই নানানভাবে বঞ্চিত। কর্মক্ষেত্র, সংসার, পরিবার, সমাজসহ রাষ্ট্রের সকল জায়গায় নারীরা নিগৃহীত। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ একটি জরুরি বিষয়। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তি পৌঁছে যাচ্ছে। গরিব ও মেধাবীদের বিনা খরচে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ, আউটসোর্সিং প্রশিক্ষণসহ শিশুদের জন্য একটি কম্পিউটার স্কুল প্রতিষ্ঠা করার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও জানালেন তিনি। লিপি বললেন, “জীবনে বাধা-বিপত্তি আর ঘাত-প্রতিঘাত আসতেই পারে। তবে সেই ঘাত-প্রতিঘাত উপক্ষো করে এগিয়ে চলার নামই জীবন। কষ্টের মাঝে কোনো কিছু পাওয়ার আনন্দটা একটু বেশিই।”