লোকায়ত জ্ঞান ও চিকিৎসকদের পরামর্শে রহিমা বেগম মুরগির চিকিৎসা করেন
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
“বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণ কর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর”। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই হলো নারী। ঐতিহ্যগতভাবে এই সব গ্রামীণ নারীরা কৃষি ক্ষেত্রের পাশাপাশি সাংসারিক অন্যান্য কাজের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছেন। তবে কৃষি উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে তারা অন্তরঙ্গভাবে জড়িত। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক চাষী পরিবারের অনেক নারী তাদের নিজস্ব উদ্যোগে এবং স্বামীর সহযোগিতায় বাড়ির আঙিনায় ও আশেপাশে সবজি চাষ ও বাড়িতে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন করে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি পরিবারের অতিরিক্ত আয়ের ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছেন আবহমানকাল থেকে। এমনই একজন গ্রামীণ নারী ধুমঘাট গ্রামের রহিমা বেগম (৪২)। গ্রাম পর্যায়ে পারিবারিক খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে গ্রামীণ নারীর ভূমিকা সবচেয়ে বেশি।
মুরগি চাষ সম্পর্কে রহিমা বেগম বলেন, “আমি শ্বশুরবাড়ি এসে দেখেছি, আমার শ্বাশুরী হাঁস-মুরগি পুষতেন। তবে হাঁস বেশি পুষতেন। মুরগি ছিল কম। তাকে দেখে এবং সংসারের আর্থিক অবস্থা ও পরিবারের সকলের পুষ্টির দিকটা চিন্তা করে আমি আমার শ্বাশুরীর সাথে সাথে মুরগি পালন শুরু করি।” তিনি আরও বলেন, “প্রথমে আমি আমার এক চাচাতো বোনের নিকট থেকে ৩টা মুরগির বাচ্চা নিয়ে পুষতে শুরু করি। মুরগিগুলো যখন বড় হয়ে ডিম দিতে শুরু করল তখন হঠাৎ মড়ক (রোগাক্রান্ত) লেগে আমার সব মুরগি মরে গেল। আবারো গ্রাম থেকে কয়েকটি মুরগির বাচ্চা সংগ্রহ করি। সেগুলোও আবার একটা সময়ে এসে মারা গেল। এরপর আমাদের বাড়িতে আমার এক দাদি শ্বাশুরী বেড়াতে আসেন আমার মুরগি মোড়কের কথা শুনে মুরগির রোগ নিরাময়ের পদ্ধতি সম্পর্কে বলেন”। তিনি বলেন, “এরপর আমি আবারো বাচ্চা ও বড় মুরগি সংগ্রহ করে পুষতে শুরু করি। এসবের পাশাপাশি মাঝেমধ্যে সরকারি পশু হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শ গ্রহণ করি। এরপর থেকে আমার মুরগি আর খুব বেশি রোগাক্রান্ত হয়নি। গ্রামীণ নারী রহিমা বেগম স্থানীয় জাতের মুরগি চিকিৎসার কয়েকটি পদ্ধতি নিম্নে তুলে ধরা হল:
১. বাচ্চা অবস্থায় অর্থাৎ ০-৩ মাস বয়স পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত মুরগির বাচ্চার চোখে ড্রপের ফোটা দিয়ে থাকেন তিনি। ৩ মাস পূর্ণ হয়ে গেলে সেখান থেকে রেনামাইসিন ট্যাবলেট ও ইনজেকশন ব্যবহার করেন। এতে করে মুরগির রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম হয়ে যায়। এ বিষয়টি তিনি সরকারি পশু হাসপাতাল থেকে জেনেছেন।
২. বড় বা ছোট মুরগির খাদ্য হজমের সমস্যা হলে হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে তিনি ফিটকিরি মিশানো পানি এবং আগাছা পাতার রস খেতে দেন। তারপরও যদি না হয় তাহলে মুরগির টোসা/পেট সামান্য কেটে ভিতরে জমে থাকা খাদ্যগুলোকে ফেলে দিয়ে ধুয়ে সুঁই-সুতা দিয়ে সেলাই করে দিয়ে রেনামাইসিন ট্যাবলেট গুড়ো করে গরম ভাতের সাথে মিশিয়ে অল্প পরিমাণে খাইয়ে দেন। এভাবে চিকিৎসার ফলে ধীরে ধীরে মুরগি সুস্থ হয়ে ওঠে।
৩. এছাড়া রেনামাইসিন ট্যাবলেট গুড়া করে গরম ভাতের সাথে মিশিয়ে খেতে দিই পনের দিন পর পর এবং প্রতিমাসে একবার করে সরকারি পশু হাসপাতালের পরামর্শ মোতাবেক রানীক্ষেত ইনজেকশন দিয়ে থাকি। সরকারি পশু হাসপাতাল থেকে ইনজেকশন ক্রয় কওে নিয়ে আসি পাকা কলার ভিতর ভরে। এরপর বাড়ি এনে পানি ফুটিয়ে ঠান্ডা করে তার মধ্যে ওষুধ মিশিয়ে এক একটি মুরগির পায়ের মাংসে ১ সিসি পরিমাণ পুশ করতে হয়। এভাবে একটি ইনজেকশন ১০০টি মুরগিকে দেওয়া যায়। এটি নিয়মিত করলে মুরগি রোগাক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম হয়ে যায়।
৪. অনেক সময় মোরগ-মুরগির মাথার ঝুটি বা অন্য স্থানে ক্ষত হয়ে ঘা হয়ে যায়। ঐ ঘায়ে পোকার জন্ম হয়। সেক্ষেত্রে যে পদ্ধতি অনুসরণ করেন সেট হচ্ছে প্রথমে ঐ ক্ষতস্থান থেকে চিমটি দিয়ে পোকাগুলো তুলে ফেলে দিয়ে পানি দিয়ে ক্ষতস্থান ধুয়ে পরিস্কার করেন। এরপর কাপড় দিয়ে মুছে ন্যাপথল গুড়ো করে লাগিয়ে দেন। ন্যাপথল ক্ষতস্থানের পোকা দমনে সাহায্য করে এবং ক্ষত সারতে হলুদ ও চুন একত্রে মিশিয়ে পেস্ট বানিয়ে সামান্য গরম করে লাগিয়ে দেই। যেটা ব্যথা এবং ঘা দুটোই সারতে সাহায্য করে। কয়েকদিন এভাবে চিকিৎসা করলে মোরগ-মুরগি সুস্থ হয়ে উঠবে। এসব কৌশল তিনি তাঁর লোকায়ত জ্ঞান এবং সরকারি পশু হাসপাতালের চিকিৎসকদের পরামর্শে প্রয়োগ করে বলে তিনি জানান।
বর্তমানে রহিমা বেগমের ২৬টি মোরগ-মুরগি (৫টি মোরগ ও ২১টি মুরগি) আছে। মেরি হাঁস আছে ২টি। কবুতর আছে ৩টি। টিটি আছে ২টি। শালিক আছে একটি। হাঁস-মুরগির ঘরটি পর্যাপ্ত আলো বাতাস পায় এ রকম পরিবেশে বাঁশ এবং খড়ের ছাউনিতে তৈরি করেন। প্রতিদিন কমপক্ষে ১০-১২টি ডিম সংগ্রহ করেন। প্রতিমাসে প্রায় ১২০০-১৫০০ টাকা ডিম বিক্রি করতে পারেন বলে তিনি জানান। পাশাপাশি পরিবারের চাহিদা ও বাচ্চাদের অনেক ইচ্ছা ও আবদার পূরণ করতে পারছেন। তিনি বলেন, “এখন আমি হাঁস-মুরগি পালনে অন্যদেরকে পরামর্শ ও উৎসাহ প্রদান করতে পারি। এ কাজে সার্বিকভাবে আমি আমার পরিবারের সকলের সাহায্য-সহযোগিতা পাই।”
একজন গ্রামীণ নারীর পারিবারিক অবস্থা ও সামাজিক মর্যাদা উন্নয়নে এ ধরনের চর্চা ও অবদান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের প্রত্যাশা।