হারিয়ে যাচ্ছে গ্রীষ্মের প্রকৃতি রাঙানো জারুল ফুল
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
‘সবচেয়ে সুন্দর করুণ/ সেখানে সবুজ রাঙা ভ’রে মধুকূপী ঘাসে অবিরল/ সেখানে গাছের নাম: কাঁঠাল, অশ্বথ, বট, জারুল, হিজল/ সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ।’ —চরণগুলো বংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি জীবনানন্দ দাশের ‘রূপসী বাংলা’ কাব্যের ‘এই পৃথিবীতে এক স্থান আছে’ কবিতার। গ্রামবাংলার প্রকৃতি নিপুণ হাতে তিনি তুলে ধরেছেন একান্ত আপন মনে। তাঁর কবিতায় গ্রীষ্মের খর তাপের একটু প্রশান্তি বেগুনি আভার জারুল ফুলের সরব উপস্থিতি লক্ষনীয়।
গ্রীষ্মটা বিদায় নিচ্ছে একটু একটু করে, গনগনে প্রখর রোদে প্রশান্তির ছায়া দেয় গাছ আর মনের অবসাদ দূর করে গাছের ফুল। প্রকৃতির অনবদ্য রূপ রশ্মি নিয়ে এ ঋতুতেই হাজির হয় জারুল। অসম্ভব সুন্দর বেগুনি রঙের থোকা থোকা জারুল ফুল যেন এক পশলা মনের প্রশান্তি। গ্রীষ্মের দাবদাহের সঙ্গে যেন প্রতিযোগিতা করে পথে প্রান্তরে ফুটছে জারুল ফুল।
জানা যায়, গ্রীষ্মের শুরুতেই ফোটে থোকায় থোকায় বেগুনি রঙের ফুল। গ্রীষ্মের ফুল হিসেবে স্বীকৃত হলেও শরতের শেষ পর্যন্ত এর দেখা মেলে। ফুলগুলো থাকে গাছের ডগায় উপরের স্তরে। প্রতিটি ফুলের ছয়টি পাপড়ির মাঝে থাকে হলুদ রঙের পরাগকোষ। ছয়টি মুক্ত পাঁপড়িতে গঠিত এর ফুল। যদিও এর রঙ বেগুনি, তবুও অনেক সময় এর রঙ সাদার কাছাকাছি এসে পৌঁছায়। মাঝারি আকৃতির এই গাছটি ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত লম্বা হয়। ফুলটির ইংরেজি নাম Giant crape-myrtle। ফুলটি Lythraceae পরিবারভুক্ত। এর বৈজ্ঞানিক নাম Lagerstroemia Speciosa।
প্রকৃতিগত কারণে নানা গাছপালা আর ফুল-ফলের অপার সৌন্দর্য্যরে জেলা মানিকগঞ্জের সুখ্যাতি বেশ প্রাচীন। অন্যান্য ঋতুর মতো গ্রীষ্মের ফুলে সাজনো থাকতো প্রকৃতির কোলজুড়ে। কিন্তু কাল পরিক্রমায় জারুল গাছ কমে যাচ্ছে আশংকাজনক হারে। প্রকৃতির মাঝে এই জারুল ফুলের সৌন্দর্য অবলোকন করা এখন আর তেমন চোখে পড়ে না।
উদ্ভিদ বিষয়ক তথ্য -উপাত্ত মারফত জানা যায়, জারুলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে ইংরেজরা উনিশ শতকে এখান থেকে বীজ নিয়ে কুয়ালালামপুর ও ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জের অনেক শহরে লাগায়। তাই ভারতীয় উপমহাদেশের গাছ হলেও জারুলের দেখা মেলে অন্যান্য দেশেও!
বাংলাদেশ ছাড়াও চীন, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশেও জারুল দেখতে পাওয়া যায়। এটি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক প্রজাতির গাছ। সাধারণত নিম্নাঞ্চলের জলাভূমিতে ভালো জন্মে। তবে শুকনো এলাকাতেও জন্মায়। অসংখ্য শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট জারুল দেখতে অনেকটা ছাতার মতো। শীতকালে জারুলের পাতা ঝরে যায়। বসন্তে গাছে নতুন পাতা আসে এবং গ্রীষ্ম আসতে না আসতেই গাছ ছেয়ে যায় হালকা বেগুনী রঙের ফুলে ফুলে। ফুলের পরে আসে ফল। জারুল গাছে এত ফল ধরে যে গাছ নুয়ে পড়ে! বীজ থেকে খুব সহজেই চারা গজায় এবং বাড়েও বেশ দ্রুত।
পরিবেশ ও প্রকৃতি রক্ষা আন্দোলনের নেত্রী লক্ষ্মী চ্যাটার্জ্জী জানান, হালকা বেগুণী রঙের মাঝে হলুদ যেন ফুলের সৌন্দর্য বাড়িয়ে তোলে শতগুণ! জারুল কাঠ লালচে রঙের, অত্যন্ত শক্ত ও মূল্যবান। ঘরের কড়ি-বগড়া, লাঙ্গল, আসবাবপত্র ইত্যাদি তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। শোভাবর্ধনকারী গাছ হিসেবেই জারুল বেশি জনপ্রিয়। তবে গ্রাম বাংলার প্রকৃতি থেকে জারুল কমে যাচ্ছে। সরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে বেশি বেশি জারুল গাছ রোপণ করে বাংলার ঐতিহ্য বহনকারী এই ফুল রক্ষার বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।
বিশিষ্ট আয়ুর্বেদীক চিকিৎসক ডাঃ পরিতোষ সাহা জানান, জারুল গাছের রয়েছে ভেষজ গুণাগুণ। এর বীজ, ছাল ও পাতা ডায়াবেটিস রোগের ওষুধ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এ ছাড়া জ¦র, অনিদ্রা, কাশি ও অজীর্ণতায়ও জারুল উপকারী।