দিলরুবা সুখে আছেন
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
একসময় গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর গোলা ভরা ধান ছিল দিলরুবা আক্তারের (২৭) বাবার বাড়িতে। কিন্তু মানুষের জীবন প্রতিনিয়তই বদলায়, বদলায় তার চারপাশ। এভাবেই মাত্র নবম শ্রেণীতে পড়াকালীন সময় দিলরুবার বিয়ে হয় অত্যন্ত দরিদ্র এক পরিবারে। স্বামীর মোট সম্পদ বলতে ছিল মাত্র দুই শতাংশ বাড়ি ভিটা! চাষের কোন জমি ছিল না। আয়ের একমাত্র পথ ছিল স্বামীর কায়িক শ্রম। স্বামী অন্যের বাড়িতে দিন মজুরির কাজ করতেন, অনেক সময় অন্যের দোকানে কাজ করতেন। স্বামীর সামান্য আয়ে কোন রকমে সংসার চলতো!
গ্রামের অন্যান্য সাধারণ নারীরা যেমন সংসারের খরচের জন্য পুরোপুরি স্বামী বা পুরুষ সদস্যদের আয়ের উপর নির্ভরশীল, দিলরুবা আক্তার ছিল তার ব্যতিক্রমী। স্বামীর উপর নির্ভরশীল না থেকে বিয়ের পর দিলরুবা আক্তার নিজ চেষ্টায় এসএসসি পাস করেন। পিতা ও শ্বশুর বাড়ি এবং আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকে তিনি কোন সহযোগিতা পাননি। তাই বলে তিনি দমে যাননি বরং চেষ্টা করতে থাকেন নিজে কিছু করে সংসারের আয় বৃদ্ধিমূলক কাজ করে সংসারের স্বচ্ছলতা আনতে। এক সন্তানের মা দিলরুবা নিজ উদ্যোগে যুব উন্নয়ন থেকে সেলাই প্রশিক্ষণ, হাসঁ-মুরগি ও গবাদি পশু-পাখি পালন বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। স্বামীর সহযোগিতায় তিনি স্থানীয় জাতের কিছু হাসঁ-মুরগি ক্রয় করে লালন-পালন করতে থাকেন, হাঁস-মুরগি ও ডিম বিক্রি করে একটি ছাগলও ক্রয় করেন। একটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে তিনি একটি গরু কিনে লালন পালন আরম্ভ করেন। হাঁস-মুরগি ও ডিম বিক্রি করে তিনি ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেন। বর্তমানে তার গোয়ালে চারটি ছাগল ও দু’টি গরু রয়েছে। এরপর তিনি হাঁস-মুরগি, ডিম ও ছাগল বিক্রি করে একটি সেলাই মেশিন ও কিছু কাপড় কিনে ঘরেই সেলাইয়ের কাজ শুরু করেন।
এভাবেই নানান আয়মূলক কাজের মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ দিয়ে তিনি ১০ শতাংশ জমি ক্রয় করেন এবং বাড়ি তৈরি করেন। পরবর্তীতে তিনি পুনরায় ওই বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে এবং নিজের জমানো টাকাসহ আরও ৩০ শতাংশ জমি কিনেন। এই ৩০ শতাংশ জমিতে তিনি ধান চাষ শুরু করেন। ৩০ শতাংশ জমি থেকে বছরে প্রায় ৩০ মণ ধান উৎপাদন করেন। এই উৎপাদিত ধান দিয়েই তাদের বছরের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়।
দিলরুবা আক্তার সেলাইয়ের কাজের অভিজ্ঞতা শুধু নিজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখেননি, ছড়িয়ে দিয়েছেন গ্রামের অন্যান্য নারীদের মাঝেও। তিনি গ্রামের আগ্রহী নারীদেরকে সেলাই শেখান। বর্তমানে ১২জন নারী তাঁর বাড়িতে এসে সেলাইয়ের কাজ শিখছেন। তিনি নিজস্ব ডিজাইনে বাচ্চাদের পোষাক তৈরি করে নেত্রকোনা শহরের বিভিন্ন্ গার্মেন্টসের দোকানে বিক্রি করেন। বর্তমানে প্রতি মাসে তিনি প্রায় গড়ে ৩০,০০০ হাজার টাকা আয় করেন। গ্রামের ১২ জন নারী তাঁর সেলাইয়ের কারখানায় কাজ করছে এবং নিজেদের পারিবারিক স্বচ্ছলতা আনার চেষ্টা করছেন। সমাজের মানুষের নিকট তিনি প্রমাণ করেছেন যে, মনের ইচ্ছা প্রবল হলে দারিদ্রতা জয় করা দূরহ কোন কাজ নয়। ভাগ্যের উপর গা ভাসিয়ে না দিয়ে যে কোন কাজে মনোনিবেশ করে পরিশ্রম করলে সফল হওয়া সম্ভব।
দিলরুবা আক্তারের চেষ্টা ও সফলতা এলাকার সকলের কাছে প্রসংশনীয় এবং অনুকরণীয়। মনোবল, কর্ম প্রচেষ্টা ও নিষ্ঠাই যে পারে একজন মানুষকে সফলতার শিখরে পৌছে দিতে তার বাস্তব উদাহরণ দিলরুবা আক্তার। তার অক্লান্ত পরিশ্রম ও মনোবলের কারণেই আজ তিনি মাত্র দুই শতাংশ জমির মালিক থেকে ৪০ শতাংশ জমির মালিক হয়েছেন। দিলরুবা এখন স্বামী ও একমাত্র সন্তানকে নিয়ে খুব সুখেই সংসার করছেন।