একজন নিভা রানী পাল
ঢাকা থেকে পাভেল পার্থ
নেত্রকোণা অঞ্চলে সনাতন হিন্দুদের পূজা ও বিয়ে কৈতরী ঘট ও জলঘট ছাড়া হয় না। নিভা রানী পাল একজন দুর্দান্ত কৈতরী ঘট কারিগর। তাঁর হাতে গড়া কৈতরী ঘটগুলির মাপ, মসৃণতা, চিকনাই, ওজন ও স্থায়িত্ব অনেক জায়গাতেই সুনাম অর্জন করেছে। নেত্রকোণার আটপাড়া উপজেলার চাইড়া নদীর পাড়ে বাখরপুর গ্রামে ১৯৬৫ সালে এক কুমার পরিবারে জন্ম। ৩ বোন ও ৩ ভাইয়ের ভেতর নিভা রানী ষষ্ঠ। মাটি শিল্পের হাতেখড়ি দিদিমার কাছে আর বানিয়াজান প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়েছেন দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত। কৈশোরে বিয়ে হয় এবং চলে যান মোহনগঞ্জ। ১৯৯০ সালে ফিরে আসেন জন্মগ্রাম বাখরপুরে এবং বর্তমানে এ গ্রামেই বসবাস করছেন। মাটির বৈচিত্র্য সুরক্ষা ও মাটিনির্ভর কুমারদের ঐতিহ্যগত পেশা টিকিয়ে রাখার আন্দোলন করে চলেছেন। কুমার পরিবারের নারীদের নিয়ে তৈরি করেছেন কুমার নারী সংগঠন। তার কাছ থেকে মাটির জিনিস বিশেষ করে কইতরী ঘট বানানো শিখেছেন পুতুল রানী, কণিকা রানী ও সুজলী রানীসহ অনেকেই। নিভা রানী মনে করেন, ঘর থেকে বিদ্যালয়, অফিস থেকে আদালত সর্বত্র মাটির জিনিসের ব্যবহার শুধুমাত্র কোনো পেশাজীবী জনগোষ্ঠীকেই টিকিয়ে রাখবে তা নয়; এটি পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সব কিছুর জন্যই ভালো। বিপদজনক প্লাস্টিক বাজারের বিরুদ্ধে মাটির জিনিসের ব্যবহার হতে পারে এক সক্রিয় আন্দোলন। নিভা রানী পাল স্বপ্ন দেখেন নতুন প্রজন্মের কুমারেরা মর্যাদা ও আত্মবিশ্বাস নিয়েই সমৃদ্ধ করবে দেশের মাটি ও মৃৎশিল্পের ঐতিহ্য। সুমিত্রা রানী ও গগণ পালের কন্যা নিভা রানী পালের আত্মজৈবনিক বয়ান থেকে তৈরি হওয়া চলতি লেখাটিতে খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁর শিক্ষা, দর্শন, স্বপ্ন ও সংগ্রাম।
একজন মনমোহিনী
শৈশবে বর্ষাকাল ছিল সবচে’ প্রার্থনার ঋতু। বর্ষাকাল এলেই নৌকায় করে মায়ের সাথে মদনের নুনশ্বরে মামার বাড়ি নাইওর যাওয়া যেত। নিভা রানীর দিদিমা ছিলেন নুনশ্বর পালপাড়ার বিখ্যাত এক কারিগর। তাঁর তৈরি জলঘট, কৈতরী ঘট আর সন্দেশের সাঁজ যেন জুরি মেলা ভার। মনমোহিনীই ছিলেন নিভা রানীর বাল্যকালের শিক্ষাগুরু। নুনশ্বরে নিভা রানীর পুরো সময় কাটতো দিদিমার কারিগরি দেখে। কাদামাটি ছেনে ছেনে দিদিমা কিভাবে তৈরি করতেন কোনো ঘট, সরা, পুতুল কী বাঘ নিভা রানীর কাছে সেসব জাদু মনে হতো। মাটি তৈরি থেকে শুরু করে রঙ দেওয়া পর্যন্ত কৈতরী ঘট তৈরির পুরো কলাবিদ্যা শিখতে নিভা রানীর কয়েক বছর লেগেছিল। প্রায় চল্লিশ বছর ধরে বানাচ্ছেন কিন্তু এখনো দিদিমার সেই নিখুঁত টান সব ঘটে একেবারে আনতে পারেন না নিভা রানী। কিন্তু তিনি মনে করেন চেষ্টার কোনো শেষ নেই, অনুশীলনের কোনো বয়স নেই।
মাটির জাত
সমাজে যেমন মানুষের জাত অনেক, মাটিরও তেমনি অনেক জাত। এক এক জাতের মাটি এক এক কিছু জন্ম দেয়। মৃৎশিল্পে লাল মাটি, চিকনা মাটি ও বড় বালু মাটি লাগে। লাল মাটির প্রধান উৎস হাওরের কৃষিজমি। তবে সব ধরনের জমিনে এই মাটি পাওয়া যায় না। টগরা (অপেক্ষাকৃত উঁচু ও শুষ্ক) জমিনে বেশ খানিকটা ভেতরের স্তরে থাকে এই মাটি। মাটি আঠালো ধরনের। ২০১৫ সালে এক কাঠা জমির মাটি খুঁড়ে এই মাটি সংগ্রহ করলে জমির মালিককে ৫ মণ ধান দিতে হয়েছে। এক কাঠা জমি থেকে ৪০০ মণ মাটি সংগ্রহ করা যায়। এর বেশি করলে জমির গুণ নষ্ট হতে থাকে। চিকনা মাটি এক ধরনের এঁটেল মাটি, সাধারনত হাড়ি-পাতিল বানানোর জন্য এ মাটি ব্যবহার করা হয়। উঁচু কৃষি জমি থেকে এ মাটি সংগ্রহ করা হয়। এক কাঠা জমি থেকে এ মাটি ৪০০ মণের কম সংগ্রহ করা যায় এবং এর জন্যও ৫ মণ ধান দিতে হয়। পাল সম্প্রদায়ের একজন কেউ এই মাটি কেনার সামর্থ্য রাখেন না। ১৭-১৮ জন মিলে এ মাটি কিনে নদীর ধারে স্তুপ করে রাখেন। তারপর নিজেদের ভাগের মাটি এনে বাড়ির উঠানে স্তুপ করে রাখেন।
উঁই ঢিবি ও কাঁকড়ার মাটি
কেবল জমির মাটি নয়, মৃৎশিল্পে উঁই ঢিবি এবং কাঁকড়া গর্তের মাটিও লাগে। মূলত সনাতন হিন্দুদের প্রতিমা বানাতে লাল ও চিকনা মাটির সাথে উঁই ও কাঁকড়া গর্তের মাটি লাগে। বর্ষাকালের আগেই এসব মাটি সংগ্রহ করে রাখা হয়। বসতবাড়ির প্রাচীন আঙিনা বা গ্রামীণ বনের উঁচু স্তুূপ থেকে উঁই ঢিবির মাটি সংগ্রহ করা হয়। উঁই ঢিবির মাটি সংগ্রহ করতে গিয়ে পুরো ঢিবির ক্ষতি করা যায় না। উঁইদের রানী পোকাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়। যেন উঁইয়ের বংশ নির্মূল না হয়। উঁই ঢিবির মাটি দিয়ে প্রতিমার গায়ে প্রাকৃতিক রঙের প্রলেপ দেওয়া হয়। এটি এক ধরণের আঠাল রঙের কাজ করে, যা মসৃণ করে ও উজ্জ্বলতা বাড়ায়।
অঘ্রাণী বন
কেবল মাটি নয়, মৃৎশিল্পে আমন ধানের খড় লাগে। আমন মওসুমের ধান জাতগুলো লম্বা হয়, এদের খড়ও শক্ত হয়। প্রতিমা বানানোর জন্য ধান কাটার সময় খড়ও নিয়ম করে কাটতে হয়। একেবারে গাছের তলা থেকে কাটা হয়। স্থানীয়ভাবে একে ‘গুড়ি কাটা বন’ বলে। এই খড় দু’ভাবে ব্যবহার করা হয়। প্রতিমার প্রাথমিক মূল কাঠামোটি খড় দিয়ে দড়ি প্যাঁচিয়ে তৈরি করা হয়। আবার খড় ছোট টুকরো টুকরো করে কেটে কাদা-মাটির সাথে মিশিয়ে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে আমন মওসুমের লম্বা শক্ত খড় পাওয়া যায় না। ইরি ধানের (উচ্চ ফলন শীল ধান জাত) খড় খাটো এবং খুব একটা শক্ত নয়। খড়ের অভাবে এখন প্রতিমার মূল গড়ন খুব একটা পোক্ত হয় না। এ কারণে প্রতিমার গায়ে নিখুঁত কাজগুলো করা কঠিন হয়ে পড়েছে। আগের দিনে কৃষক পরিবার থেকে খড় আনা যেত, বিনিময়ে মাটির হাড়ি পাতিল দেওয়া হতো। দিনে দিনে এই বিনিময়প্রথা ওঠে গেছে, এখন সবই বাজার থেকে চড়া দামে কিনতে হয়।
বড় বালু
সিলেট, সুনামগঞ্জের নদী থেকে এই বড় বালু আনে মহাজনেরা। মহাজন থেকে ছোট নৌকায় করে এনে গ্রামে গ্রামে পাল পাড়ায় এসব বড় বালু বিক্রি হয়। এসব বালুমাটির পাতিল ও কলসের নিচে বিশেষ আস্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। বড় বালুর প্রলেপ না থাকলে মাটির পাতিলে মুড়ি ভাজা যায় না। এছাড়া আগুনের তাপে পাতিল ফেটে যায় দ্রুত। বড় বালু মাটির জিনিসকে আরো মজবুত করে।
হারানো রঙ
আগে মাটির কাজে নানা প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহৃত হতো। কুপি বাতির শিষ থেকে কালো কার্বন গুটলিগুলো রাখা হতো। যেসব সরিষার তেলের সাথে মিশিয়ে কাল রঙ তৈরি হতো। শিম ও কচু পাতা পিষে সবুজ রঙ তৈরি হতো। চুন ও চক পাউডার দিয়ে সাদা রঙ তৈরি হতো। আবির বা খুনি রঙ দিয়ে লাল রঙ এবং হলুদ পিষে হলুদ রঙ তৈরি করা যেতো। কাপড়ে দেওয়ার নীল গুড়োই নীল রঙ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তেঁতুল বীজ পানিতে ভিজিয়ে জ্বাল দিয়ে এক ধরনের আঠাল দ্রবণ তৈরি হতো। এই দ্রবণের সাথে রঙ মিলিয়ে ব্যবহার করা হতো। এছাড়া তেঁতুলের এই আঠাল দ্রবণ দিয়ে মাটির জিনিসে প্রলেপ দেওয়া হতো যাতে পানিতে তা নষ্ট না হয়। কলা গাছের বাকল ও সুপারি গাছের পাতা দিয়ে ‘আঁচড়া (এক ধরণের তুলি)’ বানিয়ে তা রঙ দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হতো। মূলত নারীরাই এসব রঙ বানাতে জানতেন এবং রঙ দেওয়ার কাজটি নারীদেরই দখলে ছিল। এখন সেসব রঙ ব্যবহার অনেক কমে গেছে। এখন বাজারের কৌটার রঙ ও কেরোসিন তেল এবং তুলি ব্যবহৃত হয়। এখন রঙের কাজে পুরুষদেরও করতে দেখা যায়।
মাটি ছাড়া হবে না
বর্তমানে প্লাস্টিকের জিনিস বাজার দখল করে ফেলেছে। মাটির জিনিসের উৎপাদন, বিক্রি ও ব্যবহার কমে গেলেও এখনও জীবনযাপনের অনেক কিছুই মাটির জিনিস ছাড়া হয় না। মুড়ি ভাজার পাতিল, আইল্যা (তুষ ও টিক্কা দিয়ে ধোঁয়া তৈরির একটি পাত্র), জলঘট, ধূপতি, কল্কি, দই বসানোর পাত্র, মাছ ধরার জালের কডি এরকম অনেক কিছু এখনও টিকে আছে যা কেবলি মাটির তৈরি এবং দীর্ঘ সময়জুড়েই এর ব্যবহার বদলায়নি।