চিকুনগুনিয়া: আতঙ্কিত না হয়ে যা করণীয়!
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল
অফিসে একের পর একজনের অদ্ভুত এক জ্বর শুরু হলো। লোকমুখে জানা গেল নাম তার চিকুনগুনিয়া। হঠাৎ ভয়াবহ জ্বর, প্রচন্ড গা-মাথা ব্যথা, বমি বমি ভাব, শরীরের রেস উঠাসহ নানান উপসর্গ নিয়ে সারা ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে এ জ্বর মহামারির মতোই ছড়িয়ে পড়েছে। ঢাকার বাইরেও কোথাও কোথাও এ জ্বরের অস্তিত্ব এর মধ্যে পাওয়া গেছে বলে শুনা যাচ্ছে।
আমি যেদিন আমার এক কলিগকে কি করণীয় বুঝিয়ে বাসায় গেলাম। তার পরের দিন থেকে আমারও অবস্থা হলো একই রকম। না পারি উঠতে, না পারি বসতে, না খেতে। শরীর এক কথায় ৩/৪ দিনে প্রায় অচল হয়ে যাবার যোগাড়। এরপর একের পর এক পরিচিত, বন্ধু, কলিগরা এই জ্বরে আক্রান্ত হয়েই চলছে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে কিছুটা উন্নতি হলেও প্রায় এক মাস হলো আমি এই যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছি। গত কয়েকদিন ধরে আবার নতুন করে হাতে পায়ে ব্যথা শুরু হয়েছে। আমার পরিচিত একজনকে জানি সে প্রায় ২ মাস ধরে ভুক্তভোগী। তারও বেশি সময় ধরেও অনেকে আক্রান্ত।
তথ্যসূত্রে জানা যায়, ১৯৫২ সালে প্রথম তানজানিয়ায় চিকুনগুনিয়া শনাক্ত হয়। বর্তমানে বিশ্বের ৬০টি দেশে রোগটি ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে ২০০৮ সালে চিকুনগুনিয়া ভাইরাসের অস্তিত্ব ধরা পড়লেও এবছরের মে মাস থেকে তার প্রকোপ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। গত আট/নয় বছর স্বাস্থ্য অধিদফতর ও সিটি করপোরেশনের নিরবতার ফলশ্রুতিতেই আজকের এ পরিস্থিতির সৃষ্টি। স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাম্প্রতিক এক জরিপে প্রাপ্ত ফলাফল অনুযায়ী, ঢাকা মহানগরীতে এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে আড়াইগুণেরও বেশি। অর্থাৎ ঢাকা মহানগরীতে এডিস মশার প্রকোপ অনেক বেশি এবং এ কারণে চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্তের হারও অনেক বেশি।
এ বিষয়ে কথা বলতে চাইলে বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. লেলিন চৌধুরী বারসিক নিউজকে জানান, “চিকুনগুনিয়া হলো একটি ভাইরাসজনিত জ্বর। এটি স্ত্রী এডিস মশা দ্বারা এটি সংক্রামিত হয়। সাধারণ দিনের বেলা এই মশা কামড়ায়। এ মশার কামড়ের ফলে হঠাৎ জ্বর, প্রচন্ড শরীর ব্যথা, বমি ভাব, গায়ে রেশ উঠাসহ নানান উপসর্গ দেখা দিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে আক্রান্তকে আতঙ্কিত না হয়ে পরিপূর্ণ বিশ্রামে চলে যেতে হবে। তবে এই জ্বরও অনেকটা ডেঙ্গুর মতোই। এই জ্বর খুব দ্রুত আক্রান্তকে দুর্বল করে ফেলে। তাই প্রচুর পরিমাণ পানি, ফলের রস, সেলাইন ও তরল খাবার এবং বিশ্রামই হলো এর প্রধান প্রতিষেধক। ”
তিনি আরো বলেন, “বিগত কয়েক সপ্তাহে প্রচুর চিকুনগুনিয়া রোগি আমি পেয়েছি। বৃদ্ধ থেকে শিশু পর্যন্ত অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন।” তিনি অবিলম্বে সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে তরিৎ উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আহবান জানান।
পরিবেশ বাঁচাও অন্দোলন (পবা)-র সাধারণ সম্পাদক প্রকৌশলী মো. আবদুস সোবহান বারসিক নিউজকে বলেন, “ঢাকাসহ সারাদেশের জনগোষ্ঠির একটি বিশাল অংশ আজ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। ঢাকা মহানগরীর প্রায় প্রতিটি পরিবারে এক বা একাধিক সদস্য এ রোগের শিকার এবং জনমনে এ নিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক বিরাজ করছে।” তিনি আরও বলেন, “চিকুনগুনিয়া মশাবাহিত একটি ভাইরাস। এডিস মশাই চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহন করে। এডিস মশা সাধারণত পানিতে জন্মায়। এ মশা মূলত ভোরে ও সন্ধ্যায় মানুষকে কামড়ায়। সাধারণত মশা চিকুনগুনিয়া আক্রান্ত ব্যক্তিকে কামড়ানোর পর যদি সুস্থ মানুষকে কামড়ায়, তখন এ রোগ সংক্রমিত হয়। চিকুনগুনিয়া আক্রাক্ত ব্যক্তি শুধুমাত্র নিজেই ভোগান্তির শিকার হন তা নয়, তিনি চিকুনগুনিয়া ভাইরাস বহনকারীও বটে। মশা কামড়ানোর ৪ থেকে ৮ দিনের মাথায় এ রোগ দেখা দেয়।”
আমাদের দেশে চিকুনগুনিয়া শনাক্তকরণে সক্ষম একমাত্র সংস্থা স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) গত তিন মাসে ৬৪৩ জন ব্যক্তির রক্ত ও লালার নমুনা পরীক্ষা করে। এর মধ্যে ৫১৩ জন চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত বলে নিশ্চিত হয়েছে সংস্থাটি। অর্থাৎ আইইডিসিআর-এ পরীক্ষিত নমুনার ৮০ শতাংশ চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত। আইইডিসিআর-এর পরীক্ষার ফলাফলই ঢাকা মহানগরীতে চিকুনগুনিয়ার ব্যাপকতা প্রমাণ করে।
আমরা দেখেছি সাধারণত বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার সাথে সাথে ডেঙ্গুর ঝুঁকিও বাড়তে থাকে। চিকুনগুনিয়ার পাশাপশি ডেঙ্গুর ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে। এখন জ্বর হলেই ডেঙ্গুর পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া নিরাপদ। চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধে এখনই সচেষ্ট হতে হবে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে, এডিসসহ সব ধরনের মশার বংশ বিস্তার রোধ করতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, নাগরিক জন্য যে কাজগুলো অবশ্য করণীয় তা হলো: ঘরের বারান্দা, আঙ্গিনা বা ছাদ পরিষ্কার রাখতে হবে, যাতে পানি পাঁচ দিনের বেশি জমে না থাকে। এসি বা ফ্রিজের নিচেও যেন পানি না থাকে, তাও নিশ্চিত করতে হবে। বারান্দা ও ঘরের টব, ছাদের বাগানের পাত্র, পুরানো টায়ার, যেকোন পরিত্যক্ত পাত্রে যেন পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাথতে হবে। মশাটি দিনের বেলা কামড়ায়, তাই দিনের বেলা ঘুমালে অবশ্যই মশারি ব্যবহার করতে হবে। মশা যেন ডিম পাড়ার সুযোগ না পায় তা খেয়াল রাখতে হবে।
সিটি করপোরেশনের করণীয়
বাড়ি-ঘরের পাশাপাশি রাস্তা ও ফুটপাত এবং ডাষ্টবিনে পড়ে থাকা ডাবের খোসা ও বিভিন্ন ধরনের পাত্রে জমা পানিতে এ মশা বংশবিস্তার করে। এছাড়া রাস্তা ও ফুটপাতে জমা পানিতেও এ মশা বংশবিস্তার করে। রাস্তা, ফুটপাত ও ডাষ্টবিনে পড়ে থাকা আবর্জনা নিয়মিতভাবে পরিস্কার করতে হবে এবং ফুটপাত ও রাস্তায় যাতে পানি জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এডিসসহ সব ধরনের মশার বংশ বিস্তার রোধ করতে হবে।
চিকুনগুনিয়া প্রায় সত্তর বছরের পুরাতন হলেও এর কোন প্রতিষেধক এখনও আবিস্কৃত হয়নি। এ রোগে মনগড়া কোন ঔষধ না খেয়ে বরং বিশ্রাম নেওয়া এবং প্রচুর তরল জাতীয় খাদ্যদ্রব্য গ্রহণ করা অধিকতর শ্রেয়।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব স্থায়ী হবে। এবছর প্রধানত ঢাকায় সীমাবদ্ধ থাকলেও আগামী বছরগুলোতে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগের ভাইরাস বহনকারী এডিস মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস এবং জনসচেনতা সৃষ্টি করা জরুরী। এলক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশনের জরুরীভিত্তিতে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা প্রয়োজন।
মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশন ও স্বাস্থ্য অধিদফতরকে জরুরী ভিত্তিতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। অন্যথায় চিকুনগুনিয়ার মতো ডেঙ্গুও ব্যাপক আকার ধারণ করবে। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি, পরিবার ও কমিউনিটি পর্যায়ে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। তাই আতঙ্কিত না হয়ে সঠিক করণীয় নির্ধারণ করাটা এখন সবচেয়ে আশু কাজ। এক্ষেত্রে সকলের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার কোন বিকল্প নেই।
তথ্যসূত্র: পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)
ছবি: সংগৃহীত