স্বপ আশার আলো’র স্বপ্ন জয়ের গল্প
রাজশাহী তানোর থেকে মো. শহিদুল ইসলাম শহীদ, অমৃত সরকার, জাহিদ আলী, ইসমত জেরিন ও মো. শহিদুল ইসলাম
বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে প্রতিটি গ্রামের নিজস্ব একটি পরিচিতি থাকে। যারা গ্রামের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করে তারা সেই গ্রামের পরিচিতির ক্ষেত্রে ভৌগলিক অবস্থান, জনসংখ্যা, বসবাসকারী পরিবারের সংখ্যা, ভোটার সংখ্যা, জলাশয় নদী-নালার সংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ, গ্রামের নামকরণের ইতিহাস প্রভৃতি বিষয়গুলো গ্রামের পরিচিতি হিসেবে তুলে ধরে। কিন্তু গ্রামীন জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রামের পরিচিতির পদ্ধতি ও ধরণটি ভিন্ন। গ্রামের মানুষের পেশা, কর্মকান্ড, ন্যাযবিচার প্রতিষ্টায় নিজস্ব সামাজিক নিয়ম কানুন ও চর্চা, আচার ব্যবহার ও অন্য গ্রামের সাথে পারস্পারিক মিথস্ক্রিয়ার উপর ভিত্তি করে সেই গ্রাম সম্পর্কে এলাকায় মানুষের এক ধরনের ধারণায়ন তৈরি হয়। গ্রাম সম্পর্কে এলাকার মানুষের ধারণায়নই সেই গ্রামের পরিচয় বহন করে।
রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলার মোহর তেমনি একটি গ্রাম। গ্রামটি জনসংখ্যা ও আয়তনের দিক থেকে এলাকার অন্যান্য গ্রামের থেকে বড় হলেও সামাজিক মর্যাদার জায়গা থেকে গ্রামটি সম্পর্কে এলাকার মানুষের ইতিবাচক ধারণা ছিল না, যা গ্রামে বসবাসকারী যুব সমাজের এক মানসিক কষ্টের কারণ হয়ে উঠে। গ্রামের পরিচিতি বা নিজ গ্রাম সম্পর্কে অন্যদের ধারণার বিষয়ে যুব সমাজকে প্রভাবিত করে। গ্রামের যুবকরা এই গ্রাম সম্পর্কে অন্যদের নেতিবাচক ধারণা বদলানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। মোহর গ্রামের যুবদের সাথে আলোচনা করে জানা যায়, এই গ্রামটি আশেপাশের অন্যান্য যে কোন গ্রামের চেয়ে সম্পদশালী একটি গ্রাম। বরেন্দ্র এলাকার আবহাওয়া বিবেচনায় পানির প্রাপ্যতা পূরণে অনেকগুলো বড় বড় পুকুর রয়েছে, বিস্তর কৃষিজমি, যোগাযোগ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ গ্রামটিতে প্রতি বৃহস্পতিবার সাপ্তাহিক হাট বসে। অর্থাৎ সাধারণভাবে যেসব সম্পদকে কেন্দ্র করে একটি গ্রামকে সমৃদ্ধ গ্রাম বলা যায় তার প্রায় সবগুলোর উপস্থিতি এই গ্রামে রয়েছে। এত কিছুর পরেও গ্রামটি সম্পর্কে আশেপাশের মানুষের এই নেতিবাচক ধারণা কেন সেটিই মোহর গ্রামের যুবদের কাছেই একটি বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়।
সেই প্রশ্নের উত্তরও খুঁজে তারা তাদের নিজের মত করে চিহ্নিত করে বেশ কিছ ুসমস্যাকে। যার মধ্যে রয়েছে অসচেতনতা, অশিক্ষা, ধর্মীয় বিভাজন, নির্ভরশীলতার সম্পর্ককে গুরুত্ব না দেওয়ার বিষয়গুলো। গ্রামের এসব সমস্যা সমাধানেই ২০১৩ সালে গ্রামের যুব সমাজ একত্রিত হয়ে প্রতিষ্ঠা করে “স্বপ্ন আশার আলো” নামে গ্রাম উন্নয়ন ভিত্তিক সংগঠন। সংগঠনের সকলেই কিছু লেখাপড়া করেছে বা করছে কিন্তু প্রত্যেকেই কৃষিকাজের সাথে সম্পৃক্ত। গ্রামে গ্রামের এই ধরনের সংগঠন অনেক তৈরি হয়েছে কিন্তু অধিকাংশ সংগঠন প্রথমেই শুরু করে সঞ্চয় কার্যক্রম দিয়ে। কিছু দিন ভালো চলার পরেই টাকা পয়সার হিসাব নিয়ে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্ব থেকে আসে অনৈক্য। ফলাফল হিসেবে সংগঠনের কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়ে, একটি সময়ে সংগঠনটি আর টিকে থাকেনা। সংগঠনের এই বাস্তবতাকে বিবেচনা করে স্বপ্ন আশার আলো সংগঠনের সদস্যরা সংগঠনের পুঁজি হিসেবে টাকা সঞ্চয় করার পরিবর্তে নিজস্ব ইচ্ছা, শ্রম, মেধা ও চিন্তাভাবনা কেই গুরুত্ব দেয়। প্রয়োজন হলে নিজেরা চাঁদা দিয়ে ও গ্রামের আগ্রহী মানুষের অনুদান নিয়ে কাজ সমাধা করে থাকে।
সংগঠনের সভাপতি মোঃ সবজুল হোসেনের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২০১৩ সালে সদস্যরা গ্রামের অন্যতম সমস্যা হিসেবে অশিক্ষাকে চিহ্নিত করে। আর এই সমস্যা সমাধানে প্রথমে তারা পুরো গ্রামে একটি জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করে। জরিপের প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে দেখে গ্রামের অধিকাংশ মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এমনকি গ্রামে স্কুল থাকার পরও স্কুল উপযোগি অনেক ছেলে মেয়ে স্কুলে যায় না। যেসব পরিবারের শিশুরা স্কুলে যায় না তাদের বেশির ভাগ অভিভাবকগণই নিরক্ষর ও প্রান্তিক।
এই বাস্তবতাকে বিবেচনা করে আশার আলো যুব সংগঠনের যুবকরা এক স্বপ্ন জয়ী শপথ গ্রহণ করে। তাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় গ্রামের বয়োজোষ্ঠ্যদের নিরক্ষরতা। এই বিষয়ে আশার আলো সংগঠনের সভাপতি সবজুল ইসলাম বলেন, “গ্রামকে নিরক্ষরমুক্ত করার কাজে যুক্ত হয়ে বুঝতে পারি, বয়স্কদের নিরক্ষর মুক্ত না করতে পারলে প্রতিটি শিশুকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা যাবেনা।” তিনি আরও বলেন, “সেই থেকে প্রথমে বয়াষ্কদের অক্ষর জ্ঞান দেওয়া শুর করি। সংগঠনের সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গ্রামবাসীর সহযোগিতায় দেড় বছরের মধ্যে গ্রামের সকলকে নিরক্ষরমুক্ত করতে পেরেছি।” যুবদের এই স্বপ্ন যাত্রার সারথী ছিল বারসিক,উপজেলা শিক্ষা অফিস ও উপজেলা প্রশাসন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সহযোগিতা প্রদান আর বারসিকের পরামর্শ, দিক নির্দেশনা, শক্তি সাহস ও উৎসাহ এই কাজটি সফল করতে সহযোগিতা করেছে। এই সাফল্য গ্রামের অন্যান্য সমস্যা সমাধানে যুবদের আরো বেশি উৎসাহিত করে তুলে।
মোহর গ্রামে মুসলমান, খ্রিস্টান ও হিন্দু ধর্মাম্বলী মানুষের বসবাস। গ্রামের সার্বিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তারা জানতে পারে গ্রামের হিন্দু দর্শাবলম্বী মানুষের অন্যতম একটি সমস্যা হচ্ছে শ্মশান ঘাট না থাকা। প্রশাসনের সহযোগিতায় ও সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামের মানুষের সম্মিলিত শ্রম মেধা ও অর্থে ২০১৬ সালে গ্রামে নির্মিত হয় শ্মশান ঘাট। না, ধর্ম সেখানে কোন বাধা হয়ে উঠেনি। যেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিজ গ্রামকে এগিয়ে নেয়ার সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
গ্রামের সার্বিক উন্নয়নের জন্য যুব সমাজ গ্রামের প্রতিটি ফাকা জায়গায় রোপণ করে স্থানীয় ফলজ ও ঔষধি গাছের চারা। গ্রামের শিশুদের স্কুলগামী করতে সদস্যদের তথ্যমতে গ্রামের স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতায় প্রায় ৫০০০ গাছের চারা রোপন করা হয়েছে, যা রক্ষনা বেক্ষনের দায়িত্ব পালন করছে সম্মিলিতভাবে গ্রামের সকলে। নিশ্চিত করেছে স্কুল উপযোগি গ্রামের প্রতিটি শিশুকে স্কুলে পাঠাতে। শপথ নিয়েছেন বিয়েতে নিজেরা যৌতুক না নেয়ার ও অন্যকে না নিতে উৎসাহিত করার।
গ্রামের মানুষের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে নিজ গ্রামে স্বাস্থ্য ক্যাম্প আয়োজনের পাশাপাশি স্থানীয় সেবা কেন্দ্রগুলোতে সেবা পেতে করে চলেছেন সহযোগিতা। গ্রামে অবকাঠামো উন্নয়নসহ স্থানীয় সরকার ও প্রশাসনের সেবা ও পরিষেবা পেতে যোগাযোগ রেখেছেন অব্যাহত। যুবদের সম্মিলিত অগ্রযাত্রা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মো. আলমগীর হোসেন বলেন, “একটি সময় আমাদের গ্রামটি, মাদক, নারী নির্যাতন, বহুবিবাহসহ নানাবিধ নেতিবাচক কার্যক্রমের দ্বারাই এই এলাকায় বেশি পরিচিত ছিল, যা আমাদের ভালো লাগতো না।” তিনি আরও বলেন, “আমরা সকলে মিলে চেষ্টা করছি এই নেতিবাচক কার্যক্রম থেকে নিজেরা বেরিয়ে আসতে, গ্রামকে মুক্ত করতে। এখনও আমরা পরিপূর্ণ সফল হতে পারিনি। তবে গ্রামবাসীর আগ্রহ ও সহযোগিতা আমাদের অনুপ্রাণীত করে। আমরা সম্মিলিতভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছি, নিজের জন্য গ্রামের জন্য কিছু একটা করার। মানুষের জন্য কিছু একটা করার উৎসাহ ও প্রেরণাটি পেয়েছি আমরা বারসিকের কাছ থেকে।” অন্যদিকে স্থানীয় ওয়ার্ড মেম্বার মো. হযরৎ আলী (৪৮) বলেন, “এক সময়ে এই গ্রামে স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তি বা প্রশাসনের লোকজন কোন বিচার সালিশ করতে বা গ্রামের মানুষের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগকে কেন্দ্র করে আসত। কিন্তু বর্তমানে তারা আসে গ্রামের কোন উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড উদ্বোধন করতে বা উৎসাহ দিতে। এই পরিবর্তনই গ্রামের একজন সদস্য হিসেবে আমাদের ভালো লাগার জায়গা। এই ভালোলাগাকে নিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে চাই। এলাকার মানুষকে শুনাতে চাই আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় স্বপ্ন জয়ের গল্পকথা।”