রেণুপোণা আহরণে নীতিমালা না থাকায় সুন্দরবনে জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে
সাতক্ষীরা থেকে আসাদ রহমান:
গত শতাব্দীর ৮০’র দশক থেকে সাতক্ষীরা দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে নদী থেকে লোনা পানি নিয়ে ঘেরে মাছ চাষ করা হচ্ছে। বিশেষ করে সুন্দরবন উপকূলীয় এলাকায় এসব ঘের গড়ে উঠেছে। সাতক্ষীরা শ্যমনগর উপজেলার সুন্দরবন সংলগ্ন গাবুরা, বুড়িগোয়ালিনী, মুন্সিগঞ্জ, রমজানগর, কৈখালী, কাশিমাড়ী এলাকায় জুড়ে রয়েছে ১০ হাজারের অধিক মৎস্য ঘের এবং ১ হাজারের বেশি কাকড়া খামার। এতে দরকার হচ্ছে হাজার হাজার রেণুু পোনার সেগুলো জেলেরা সুন্দরবন থেকে আহরণ করছেন ।
স্থানীয় সুন্দরবন বিশেষজ্ঞ পিযুষ বাউলিয়া পিন্টু বলেন, “এই অঞ্চলে ফসলি জমি বাদ দিয়ে গড়ে উঠেছে চিংড়ি মাছের ঘের। আর এই ঘেরের চিংড়ি’র রেণুপোনা যোগান দিতে সুন্দরবন থেকে অপরিকল্পিতভাবে আহরণ করা হচ্ছে রেণুপোণা। এতে সুন্দরবনের অনেক ক্ষতি হচ্ছে। অনেক হ্যাচারিতে কৃত্রিমভাবে রেণুপোণা ও কাঁকড়া ছোট বাচ্চা উৎপাদন করছেন। তবে সুন্দরবন থেকে আহরণের মতো এতো ভালো হয়না। সেজন্য ঘের মালিকদের কাছে সুন্দরবন থেকে আহরিত রেণু পোনার চাহিদা বেশী। এর দামও একটু বেশী।”
তিনি আরো বলেন, “জেলেরা ঘন জাল ব্যবকার করে চিংড়ি পোণা আহরণ করে। এর সাথে অন্যান্য ছোট মাছের পোণা বা অনুজীব উঠে আসে। জেলেরা রেণুপোনা নিয়ে বাকি মাছ এবং অনুজীবগুলো নদীতে না ফেলে মাটির ওপরে ফেলে। ফলে ধীরে ধীরে, অনেক মাছের জাত বা প্রাণীর অস্তিত্ব সংকটে পড়বে। এর বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।”
সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের পরিবেশ ও ভূগোল বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আ.ন.ম গাউছার বলেন, “সুন্দরবনের পাশে মানুষের যাতায়াতের ফলে প্রাণীদের স্বাভাবিক বাসস্থান অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়ে। তাদের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নষ্ট হয়ে যায় এবং মানুষের উপস্থিতির ফলের তারা তাদের নিজেদের গুটিয়ে নেয়। প্রজনন ক্রিয়া অস্বাভিক হওয়ার ফলে সেই প্রার্ণী বিপন্ন হয়ে যাবে।”
পরিবেশ গবেষক পাভেল পার্থ বলেন বলেন, “সুন্দরবন থেকে চিংড়ি রেণু পোনা এবং ছোট কাঁকড়া আহরণ করা হয়ে থাকে। আহরণের কোন নীতিমালা না থাকায় জেলেরা ইচ্ছামতো আহরণ করছেন এবং এর সাথে অন্যান্য অনুজীব ধ্বংস করছেন তারা। এছাড়া কাঁকড়া ও চিংড়ি মাছের রেণু পোনা সুন্দরবনের জীবকুলের যে খাদ্য শৃঙ্খল আছে সেই খাদ্য শৃঙ্খলের প্রথম সারির প্রজাতি। আর প্রথম সারির এই প্রজাতিকে ব্যাপক ও বিস্তৃত আকারে আহরনের ফলে এদের উপর নির্ভরশীল অন্যান্য শ্রেণীর পশুরাও ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। সে কারণে সুন্দরবনের জীবকুলের খাদ্য শৃঙ্খলে উলোট-পালোট শুরু হচ্ছে। এর ফলে জলজ ও ফলজ বাস্তসংস্থানের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।”
তিনি আরো বলেন, “প্রথম সারির এই প্রজাতি কাঁকড়া ও চিংড়ি আহরণের প্রভাব সুন্দরবনের শুকর, ভোদড়, কুমির, সাপ ও বাঘসহ সুন্দরবনের সব ধরণের পশুর খাদ্য শৃঙ্খলের উপর পড়ছে। এটি খালি চোখে দেখা না। ফলে দীর্ঘমেয়াদে চিংড়ি ঘের ও কাঁকড়া খামারের ফলে ভবিষ্যতে সুন্দরবন ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হবে।
তিনি আরও বলেন, গত শতাব্দীর ৮০’র দশক থেকে উপকূলীয় এলাকালোতে চিংড়ি চাষ শুরু হয়েছে। উপকূলীয় এলাকার বাঁধ বা খাল কেঁটে জমির মধ্যে লবণ পানি ঢুকিয়ে চিংড়ি চাষের ফলে প্রাণী ও জীবকুলের বাস্তুসংস্থানের ক্ষতি গ্রস্তহয়ে সুন্দরবনের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। পাশাপাশি, সনুন্দবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকায় কাঁকড়া ও চিংড়ি ঘের এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট্য প্রসেসিং জোনগুলো গড়ে উঠেছে। সেগুলো সুন্দরবনের বাস্তুসংস্থানের জন্য ব্যাপক ক্ষতিকর।
শ্যামনগর উপজেলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার কামরুজ্জামান বলেন, “উপজেলা প্রশাসন এই বিষয়ে এখন ব্যাপক সচেতন। এই অভিযোগে কিছুদিন কয়েকজন জেলেকে ভ্রাম্যমান আদালতে সাজা দেওয়া হয়েছে।”
সাতক্ষীরা জেলা প্রশাসক আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, “সুন্দরবনে চিংড়ি আহরনের কোন নীতিমালা না থাকায় অপরিকল্পিতভাবে চিংড়ি রেণুপোনা আহরণ করা হচ্ছে। তবে সর্বশেষ জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সুন্দরবন থেকে কাঁকড়া, চিংড়ি আহরণের জন একটি ঘের সংক্রান্ত নীতিমালার প্রস্তাব করা হয়েছে। আশাকরা হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি এটি হয়ে যাবে। তিনি আরও বলেন, “সুন্দরবন এলাকায় বেশ কয়েকটি কাঁকড়া ও চিংড়ি রেণুপোনা উৎপাদনকারী হ্যাচারি গড়ে উঠছে। এতে করে আগের তুলনায় সুন্দরবন কাঁকড়া ও চিংড়ি আহরণ করা কম হচ্ছে।”
সুন্দরবনের রেণুপোনা আহরণের কোন নীতিমালা না থাকায় পশ্চিম সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ এলাকার জেলেরা ইচ্ছামতো রেণু আহরণ করছেন। সাথে সাথে ধ্বংস করছেন অন্যান্য অনুজীব। অনিয়ন্ত্রিতভাবে রেণুপোনা আহরনের ফলে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের খাদ্যশৃঙ্খল নষ্ট হচ্ছে এবং বাস্তুসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে করে জীববৈচিত্র্যের অস্তিত্ব সংকট দেখা দিয়েছে এবং সুন্দরবনের উপর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে বলে অভিমত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।