বরেন্দ্র ভূমিতে আপনাকে স্বাগত
নেত্রকোনা থেকে আওলাদ হোসেন রনি
‘ওরে সবুজ, ওরে আমার কাঁচা
আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’
‘আধমরাদের ঘা মেরে’ জাগিয়ে তুলতে ‘সবুজ’ ‘কাঁচা’ তথা যুবদের ভূমিকাই মূখ্য। যে কারণে খোদ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নবীন’ ‘সবুজ’ ‘অবুঝ’ ‘কাঁচা’ তথা তারুণ্যের দ্বারস্থ হয়েছেন। শুধু কি রবীন্দ্রনাথ? বিশ্বসাহিত্য কিংবা পৃথিবীব্যাপী সমাজ প্রগতির দায় বরাবরই তরুণ সমাজই বহন করে। বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধও এই তরুণ প্রজন্মের সোনালি স্পর্শে পরিণতি লাভ করে। তারুণ্যের প্রতি ইতিহাস অর্পিত এই মহান দায়িত্ব পালনে তরুণরাও কখনো কুণ্ঠিত হয় না। ইতিহাসের প্রাচীন ভূমি বরেন্দ্র অঞ্চলের তরুণরা সে রকমই ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট হয়েছে।
বরেন্দ্র অঞ্চল বাংলাদেশ শুধু নয়, পৃথিবীর আদিভূমিগুলোর একটি। ইতিহাসের সুপ্রাচীনকালেই এ অঞ্চল বসবাসের উপযোগী হয়ে উঠেছিলো। বরেন্দ্র ভূমির ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী একে বলা হচ্ছে ‘বারিন্দ ট্র্যাক্ট’। এর ভূমি অনেকটা সিঁড়ির মতো উঁচু থেকে নিচু আর কখনো নিচু থেকে উঁচু। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিল ‘চলন বিল’ও এ অঞ্চলের অংশজাত। বরেন্দ্র অঞ্চল হিমালয় থেকে যতোটা দূরে ঠিক ততোটাই দূরে বঙ্গোপসাগর থেকে। অর্থ্যাৎ হিমালয় এবং বঙ্গোপসাগরের ঠিক মাঝখানে এই বরেন্দ্র ভূমির অবস্থান। মোঘল আমলে মোঘল স¤্রাটগণ এই বরেন্দ্র ভূমির উপর দিয়েই যমুনা পার হয়ে ঢাকায় যোগাযোগ করতেন। রাজশাহীতে অবস্থিত ‘বরেন্দ্র জাদুঘর’ পৃথিবী বিখ্যাত এবং সমৃদ্ধ জাদুঘরগুলোর মধ্যে একটি। যা বরেন্দ্র অঞ্চলের ব্যবহার্য জিনিস সংগ্রহ করে তৈরি করা হয়েছে। বরেন্দ্র ভূমির বুক ছিঁড়ে বয়ে গেছে অসংখ্য নদী যার মধ্যে পদ্মা অন্যতম। রাজশাহী শহরটি গড়ে উঠেছে এই পদ্মা নদীর তীরেই। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
বরেন্দ্রভূমিতে সবচে’ চোখে পড়বে আম গাছ। বাড়ির আঙিনা, ধানের ক্ষেত, অফিসের বারান্দা সবখানেই আমের একচ্ছত্র আধিপত্য। গাঁয়ের ছেলেদের খেলার মাঠও এই আম বাগানের মধ্যেই। তা দাঁড়িয়াবান্দাই হোক কিংবা হোক ফুটবল-ক্রিকেট। ভাগ্যদেবতা বোধহয় বরেন্দ্রবাসীর জন্য আমের বর দিয়েছিলেন! আমের পাশাপাশি চোখে পড়বে তালগাছ। কখনো খেঁজুর। তালগাছের সাথে বরেন্দ্রবাসীর ঘরের চাল-বেড়ার সম্পর্ক। বরেন্দ্রবাসীর নিজস্ব শৈলিতে নির্মিত মাটির ঘরের কাঠামো হয় এই তালগাছের কাঠে। বরেন্দ্র’র উৎপাদিত ফসলের মধ্যে ধানের পরেই রয়েছে আলু। এই দু’টি ফসলের চাষ পাশাপাশি হওয়ার কারণে বরেন্দ্রবাসী অগ্রহায়ণ মাস খুব ব্যস্ততার সাথে পার করেন।
বৈচিত্র্যময় এই জনপদের বৈচিত্র্যকে ধারণ করেই গড়ে উঠেছে ‘বরেন্দ্র শিক্ষা-সংস্কৃতি-বৈচিত্র্য রক্ষা কেন্দ্র’। সংক্ষেপে বিইডিবিসি। রাজশাহী শহরের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই সংগঠনটি। সবে একবছর পার করেছে বিইডিবিসি। এরই মধ্যে সুন্দর ও সমৃদ্ধ সমাজ গঠনে বিইডিবিসি নিয়েছে আশাজাগানিয়া ভূমিকা। সংগঠনের প্রত্যেকটি কর্মী-সমর্থকের হৃদ্যতাপূর্ণ এবং বন্ধুভাপান্ন আচরণ সংগঠনটিকে কার্যকর করে তুলেছে। স্বতন্ত্র ভৌগলিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী বরেন্দ্র ভূমির স্বাতন্ত্র্যকে ধারণ করে সংগঠনের কাজের ইস্যুগুলোও ভিন্ন। সেই ভিন্নতা থেকেই পৃথিবীব্যাপী বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে এই সংগঠন আয়োজন করে ‘ট্রি অলিম্পিয়াড-২০১৭’। যা বাংলাদেশ শুধু নয় সারা পৃথিবীতেই প্রথম। স্কুল পর্যায়ে আয়োজিত এই অলিম্পিয়াড ইতিমধ্যেই ব্যাপক সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে। একটি সংগঠন একটি সমাজেরই অংশ। সেই ধারাবাহিকতায় সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপনের মধ্য দিয়ে সংগঠনটি ব্যাপক ফলপ্রসূ কর্ম সম্পাদনে সক্ষম হয়েছে। প্রাকৃতিক দূর্যোগ বা যে কোন সামাজিক বিপর্যয়ে সংগঠনটি এগিয়ে আসে তার নতুন ধরনের সৃষ্টিশীল কাজ নিয়ে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়- গেলো বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদেরকে বিইডিবিসি সাইক্লিং এর মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে এবং প্রশাসনের সমন্বয় করে একটি ব্যাপক ত্রাণ সহযোগিতা করতে পেরেছে। এই রকম সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে বিইডিবিসি সমাজ প্রগতিতে এক অর্থবহ অংশগ্রহণের স্বাক্ষর ইতিমধ্যেই রাখতে পেরেছে।
রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলায় গড়ে উঠেছে এরকমই আরেকটি যুব সংগঠন- মোহর স্বপ্ন আশার আলো যুব সংগঠন। বৃক্ষরোপণ, স্বাক্ষরতা অভিযানসহ বিভিন্ন ব্যতিক্রমী কাজের মধ্য দিয়ে এই সংগঠনটিও রেখেছে সফলতার স্বাক্ষর। সেক্ষেত্রেও সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ-সমর্থনের মধ্য দিয়ে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণে সংগঠনটির ভূমিকা অনুসরণীয়।
তানোর উপজেলার গোকূল-মথুরা স্বপ্নচারী উন্নয়ন যুব সংগঠন। স্থানীয় জনগোষ্ঠির জীবনমান উন্নয়নে বিশেষত শিক্ষা এবং সহপাঠক্রমিক শিক্ষার মানন্নোয়নে সংগঠনির ভূমিকা বেশ প্রশংসার দাবিদার। এলাকার সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ এবং ব্যতিক্রমী উদ্যোগের ফলে সংগঠনটির কার্যকর ভূমিকা বেশ প্রশংসনীয়।
বরেন্দ্র অঞ্চলের সুপ্রাচীনকাল থেকেই সমাজ সচেতন। যার ফলাফল আমরা প্রত্যক্ষ করি- গম্ভীরা গানের মধ্যে। হাওর অঞ্চলে যেখানে বিকশিত হয়েছে মরমীয়া গান। সেখানে বরেন্দ্র অঞ্চলে বিকশিত হয়েছে সমাজ সচেতন গম্ভীরা গান।
সমাজ সচেতন বরেন্দ্র অঞ্চলের আতিথেয়তা-হৃদ্যতা-বন্ধুত্ব এবং সমাজ প্রগতির ক্ষেত্রে যুব সমাজের এই উদ্যোগ আমাদের কাছে অনুসরণীয়।