জাতীয় পতাকা আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক
চাটমোহর, পাবনা থেকে ইকবাল কবীর রনজু
‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়, দাম দিছি প্রাণ লক্ষ কোটি জানা আছে জগৎময়’ বহুল প্রচলিত এ গানটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় বাঙালি জাতির সংগ্রামের কথা। আত্মত্যাগের কথা। ১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করে স্বাধীন একটি দেশ ও লাল সবুজের পতাকা। এটি আমাদের গৌরবের প্রতীক। সবুজ আয়তক্ষেত্র সবুজ প্রকৃতি ও তারুণ্য এবং লাল বৃত্ত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় স্বাধীনতা যুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীরদের কথা। চলছে বিজয়ের মাস। আগামী ১৬ ডিসেম্বর শনিবার সারা দেশে পালিত হবে মহান বিজয় দিবস ২০১৭। দিবসটি উপলক্ষে চারদিকে পড়ছে সাজ সাজ রব। বসে নেই পতাকা বিক্রেতারাও। ভোর হতে না হতেই জীবন ও জীবিকার তাগিদে তারা বেড়িয়ে পড়ছেন জাতীয় পতাকা বিক্রি করতে। এটি তাদের আয়ের ও উৎস।
১১ ডিসেম্বর সোমবার পাবনার চাটমোহর পৌর সদরে জাতীয় পতাকা বিক্রি করতে দেখা যায় মাদারীপুর জেলার শিবচর থানার বাগমারা গ্রামের সূর্য মিয়ার ছেলে শহিদুল ইসলাম (৩৬) কে। শহিদুল ইসলাম জানান, বিগত দশ বছর যাবত বিজয়ের মাস ডিসেম্বর, ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতার মাস মার্চ ও বাংলা নববর্ষ উপলক্ষে পতাকা বিক্রি করে আসছেন তিনি। এ অনুষ্ঠানগুলোর পূর্বে দুই সপ্তাহ জাতীয় পতাকা, মাথার ব্যাচ, হাতের ব্যাচ, পকেট ব্যাচ ও কাঠির মাথায় লাগানো পতাকা বিক্রি করেন। আকার ভেদে লাল সবুজ পতাকা গুলো ২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায়, মাথার ব্যাচ ১০ টাকায়, হাতের ব্যাচ ২০ থেকে ৩০ টাকায়, পকেট ব্যাচ ১৫ থেকে ১৫০ টাকায়, কাঠি পতাকা ১০ টাকায় বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
অন্যসময় এলাকায় মাটির ট্রলির শ্রমিক হিসেবে কাজ করেন শহিদুল। তিনি আরো জানান, মানুষ বিজয়ের চেতনাকে বুকে লালন করেন। নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে যে বিজয় আমাদের পূর্ব পুরুষেরা ছিনিয়ে এনেছেন আজ সে বিজয়ের ফল ভোগ করছি আমরা। মাটির ট্রলীতে কাজ করে প্রতিদিন ৪শ টাকা পান তিনি। পক্ষান্তরে প্রতিদিন হাজার চারেক টাকার পতাকা বিক্রি করে অন্তত এক হাজার টাকা লাভ করেন। শিবচরের ৭ জন পতাকা বিক্রেতা মিলে একত্রে ঢাকার শ্যাম বাজার এলাকা থেকে বিক্রির উদ্দেশ্যে ৭০ হাজার টাকার পতাকা ও ব্যাচ কিনেছেন। রাত্রিযাপন করেন পাবনার হোটেলে। দিনের বেলায় তারা বিভিন্ন উপজেলায় বেড়িয়ে পরেন পতাকা বিক্রি করতে। এসময় অতিরিক্ত আয়ের আশায় তারা অন্যকাজ বাদ দিয়ে পতাকা বিক্রি করেন বলে জানান। যে পতাকা, ব্যাচগুলো বিক্রি হবেনা সেগুলো অন্যান্য জাতীয় অনুষ্ঠানের সময় বিক্রি করবেন বলে জানান।
মাদারীপুরের শিবচর থানার বাগমারা গ্রামের সুরত খাঁ’র ছেলে মোখলেছ (৫০) বলেন, “প্রতিটি জাতীয় পতাকা ৭০ টাকা করে কিনি। একশ’ থেকে একশ’ ৫০ টাকায় বিক্রি করি। ৩ ছেলে এক মেযে আমার। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। জমানো কিছু টাকা ও গরু বাছুর বিক্রি করে ৯ লাখ টাকা যোগাড় করে বড় ছেলে শাহীনকে গ্রীসে পাঠিয়েছি। সেখানে সে তৈরি পোশাক কারখানায় কাজ করে। দ্বিতীয় ছেলে রাসেল ঢাকায় রঙের কাজ করে। ওকে ও বিদেশে পাঠানোর ইচ্ছা আছে। ছোট ছেলে রাশেদ স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় হাফিজিয়া পড়ছে। ৫ কাঠা বাড়ি ছাড়া অন্য কোন জায়গা জমি নাই। জাতীয় দিবসগুলোর পূর্বে পতাকা ব্যাচ বিক্রি করি। অন্যসময় মানুষের খেতে খামারে কাজ করি। সব মিলিয়ে কোন মতে দিনাতিপাত করছি।”
একই এলাকার চর কামারকান্দি গ্রামের হারুন (৪০) বলেন, “জাতীয় পতাকা সম্মানের প্রতীক। গৌরবের প্রতীক। বছরের অন্যান্য সময় ফেরী করে বেডশীট বিক্রি করলেও জাতীয় দিবসগুলোর পূর্বের কয়েক দিন পতাকা বিক্রি করি। এতে বাড়তি আয় হয়। বসতবাড়িসহ ১০ কাঠা জমিন আছে। দুই ছেলে দুই মেয়ে আমার। বড় ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টস এ কাজ করে। বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি। অপর মেয়ে ষষ্ট শ্রেণীতে এবং ছেলে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়া লেখা করছে। প্রতিদিন অন্তত ৪শ’ টাকা সংসার খরচ। চাল ডাল কেনা ছাড়া ও ছেলে মেয়েদের পড়া লেখা, কাপুর চোপর ওষুধ পত্রসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে হিম শিম খাই। তাই এসময় কয়েক দিন পতাকা বিক্রি করে থাকি।”
আমজাদ হোসেন বাবুলের বাড়ি চাটমোহরের মথুরাপুর গ্রামে। পেশায় তিনি একজন কলেজ শিক্ষক। বুধবার মেয়ের জন্য কাঠি যুক্ত পতাকা কিনছিলেন। আমাজাদ হোসেন বলেন, “মেয়ে যেন স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত হয়, বিজয়ের উল্লাসে উল্লসিত হয়, বাংলাদেশের ইতিহাস সম্পর্কে অবগত হয়, বাংলাদেশকে জানতে চায় বুঝতে চায় সেজন্য তার জন্য পতাকা কিনছি।”