তবুও দীনেশ রিক্সা চালান!

তবুও দীনেশ রিক্সা চালান!

মানিকগঞ্জ থেকে ফিরে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল

মানিকগঞ্জের বড়বড়িয়াল ঋষিপাড়া গ্রামের মঙ্গল চন্দ্র দাস ও প্রিয়বালা দাসের বড় সন্তান দীনেশ চন্দ্র দাস (৫১)। জন্মের পর থেকেই তিনি একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী, তাঁর ডান হাত কব্জির উপর পর্যন্ত নেই। তবুও তিনি রিকসা চালিয়ে তার জীবন নির্বাহ করেন।

বাবা, মা আর তিন বোনকে নিয়ে তাঁর সংসার। পরিবারের পেশা বাঁশ বেতের কাজ স্থানীয়ভাবে যাকে শিল্পকাজ বলা হয়ে থাকে। তাঁর বাবা সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করেই তাদের খাওয়া পরনের জোগান দিতেন। খুব অভাবের সংসার ছিল তাদের। সহায় সম্পদ বলতে দীনেশের একখন্ড বসতভিটা ছাড়া আর কিছইু নেই। ভিক্ষা করে মানুষের কাছে কাছে হাত পেতেই তার জীবনের দীর্ঘ সময় কেটেছে। ভিক্ষা করেই তিন বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। আত্মীয় পরিজন বলতে তার তিনকূলে এখন আর কেউ নাই।

দীনেশ দাসের শৈশব কেটেছে গ্রামে। তিনি বলেন, “তখন গ্রামে এতো রাস্তাঘাট আছিলো না। বাড়িঘর ছিল ছনের। ভিক্ষা করতে করতে অনেক সময় সাভার হয়ে ঢাকা চইলা গেছি। কখনও কখনও অনেক রাতে বাড়ি ফিরতাম। খুব কষ্টের দিন ছিল তহন।”

শৈশবেই দীনেশের জীবন সংগ্রামের নতুন পথ দেখতে হয়। জীবনের নির্মম পরিহাসে তাকে ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত হতে হয়। তখন থেকেই মায়ের সাথে গ্রামে গ্রামে ঘুরে চেয়ে চিন্তে তাদের জীবন চলতো। মা’ই তাকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে যুক্ত করেছিলেন।

নিজ যৌবনের স্মৃতি হাতড়ে তিনি বলেন, “আমাদের পাড়ায় গানের মানুষ আছিল অনেক। আমি কীর্তন আর শিব পূজার সময় গান গাইতাম-এহনও গাই। বাড়ি বাড়ি যাইয়া গান গাই।” তাঁর জীবনের এক অবিস্মরণীয় ঘটনা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ, যা এখনও তাঁর চোখে জ্বলজ্বল করে ভাসে। তিনি বলেন, “পাকিস্তানি বাহিনী নতুন হাট পুড়িয়ে দিল। আমরা সবাই দৌড়ে পালালাম। অনেক বাড়িঘর লুট হইছে। মানুষরে নির্বিচারে মারছে সে সময়।”
শারীরিক প্রতিবন্ধীতার কারণে দীনেশ জীবনে অনেক কিছু হারিয়েছেন। খুব ইচ্ছা থাক স্বত্বেও তিনি স্কুলে যেতে পারেননি। কারণ স্কুলে যেতে তার লজ্জা লাগতো। আর ছিল নিদারুণ অভাব।

dinesh (3)
“ছোটবেলায় বন্ধুদের সাথে মিশতাম। কিন্তু হাত না থাকার কারণে লজ্জা লাগতো। তাই খেলতে ডাকলেও যাইতাম না। সব সামাজিক কাজ থেকেও নিজেকে গুটিয়ে রাখতাম।” দীনেশ বলেন, “বাবা জীবনে অনেক কষ্ট করছে। ৪ ভাইবোনরে খাওয়ানো পড়ানো ছিল তার কাজ। কিন্তু সংসারের খরচ জোগানো ছিল তার জন্য খুব কঠিন। আমার বাবা মারা যায় আমার বিয়ের আগে। তিন বোন আর মাকে নিয়া আমার নতুন কষ্টের দিন শুরু হয়।”

দীনেশের তিন সন্তান। এক মেয়ে, দুই ছেলে। তারা ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা করেছে। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। এক ছেলে পেশায় ফার্নিচারের দোকানে কাজ করে। মাসে তার আয় ৬০০০ টাকা। আরেক ছেলে রাজমিস্ত্রীর যোগাড়ীর কাজ করে। যেদিন কাজ থাকে সেদিন দিনে ৩০০ টাকা পায়। দীনেশ নিজে সপ্তাহে দুইদিন ভ্যান চালিয়ে মাসে ১৬০০ টাকা আয় করে থাকেন।

দীনেশ প্রতিবন্ধী হিসেবে সরকারি ভাতা পান। প্রতিবন্ধী ভাতা সর্ম্পকে দীনেশ বলেন, ‘আমি প্রথম ৬ মাসে ৩০০০ টাকা প্রতিবন্ধী ভাতা পাইছি। আর পরের তিন মাসে পাইছি ২১০০ টাকা। গ্রামের মেম্বারই ভাতার ব্যবস্থা করে দিছে। কিন্তু এই টাকায় খেয়ে পড়ে বাঁচা সম্ভব না। যদি মাসে ৩০০০ টাকা পাওয়া যেতো তবে খেয়ে পড়ে বাঁচা যেতো।” তিনি আরও বলেন, “প্রতিবন্ধি ভাতা পাওয়ার পরে এবং বিয়ের পর থেকে আমি আর ভিক্ষা করি না। সামাজিকভাবে আমার মর্যাদা একটু বাড়ছে।”

দীনেশ বলেন, “আগে অনেক কষ্ট করতাম। এখন কিছুটা সুখে আছি। ছেলেরা কামাই রুজি করে। আমার আর তেমন কাজ করতে হয় না। ছোটবেলা থেকেই আমি খুব লজ্জা আর ভয় নিয়ে বড় হইছি। যে কারণে বেশি লোকজনের মধ্যে যাইতাম না। এমনকি আত্মীয় পরিজনের কাছেওনা। এখন নিজের জীবনকে অন্যভাবে দেখি। এখন আর তেমন লজ্জা সংকোচ হয় না। কারণ আমিও মানুষ।”

happy wheels 2

Comments