বাঙালির প্রাণের উৎসব হালখাতা: সুদীর্ঘ ঐতিহ্য আর সম্প্রীতির প্রতীক
মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক
পয়লা বৈশাখ, নতুন সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় বাঙালির নতুন জীবন। পয়লা বৈশাখ আর হালখাতা যেন অনেকটা যমজ ভাইবোনের মতো। উৎসব প্রিয় বাঙালির প্রাণের উৎসব হালখাতা। অতীতে হালখাতাই ছিল বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব। এদিনটি ব্যবসায়ীদের কাছে আনন্দের দিনও বটে। হালখাতা শুধু হিসাবের নতুন খাতা খোলা নয়, পাওনা আদায়ের পাশাপাশি ক্রেতাদের আপ্যায়নের মাধ্যম। হালখাতার এই ঐতিহ্য সুদীর্ঘ কাল বহন করে চলছে বাঙালির আনন্দ উৎসব আর সম্প্রীতির গৌরবগাঁথা।
নববর্ষের হালখাতায় ব্যবসায়ীরা তাদের হিসাব-নিকাশ সম্পন্ন করে হিসাবের নুতন খাতা খুলেন। এই উপলক্ষে তাঁরা নুতন-পুরাতন খদ্দের ও শুভাকাংখীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে মিষ্টি বিতরণ করতেন এবং নতুনভাবে তাদের সঙ্গে ব্যবসায়িক যোগসূত্র স্থাপন করতেন। চিরাচরিত পহেলা বৈশাখে হালখাতার এই অনুষ্ঠানটির মাধ্যমেই বাঙালির সম্পর্ক অটুট রাখার প্রয়াস। বছরের প্রথমদিন হালখাতার রেওয়াজ থাকলেও এটা প্রায় পুরো বৈশাখ মাস থেকে শুরু করে জ্যৈষ্ঠ মাস পর্যন্ত চলে।
হালখাতার ইতিকথা
এক সময় সার্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ ছিল বাংলা নববর্ষের প্রাণ। ইতিহাস মতে, ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০-১১ মার্চ সম্রাট আকবরের বাংলা সন প্রবর্তনের পর থেকেই ‘হালখাতা’র প্রচলন হয় তৎকালীন ভারতবর্ষে। পশ্চিমবঙ্গেও এ অনুষ্ঠানটি বেশ ঘটা করে পালন করা হয়। পুরনো বছরের হিসাব বন্ধ করে নতুন হিসাব খোলা হয় যে খাতায়, তা-ই ‘হালখাতা’ নামে পরিচিত।
অতীতে জমিদারকে খাজনা প্রদানের অনুষ্ঠান হিসেবে ‘পূণ্যাহ’ প্রচলিত ছিলো। বছরের প্রথমদিন প্রজারা সাধ্যমতো ভালো পোশাকাদী পরে জমিদার বাড়িতে গিয়ে খাজনা পরিশোধ করতেন। তাদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। জমিদারি প্রথা উঠে যাওয়ায় ‘পূণ্যাহ’ বিলুপ্ত হয়েছে। তবে ব্যবসায়ী সম্প্রদায় নববর্ষে হালখাতার আয়োজন করে আজও। বাংলা সনের প্রথমদিন দোকানপাটের হিসাব আনুষ্ঠানিকভাবে হালনাগাদ করার এ প্রক্রিয়া পালন করা হয়। ব্যবসায়িরা এদিন তাদের দেনা পাওনার হিসাব সমন্বয় করে হিসাবের নতুন খাতা খোলেন। এজন্য ক্রেতাদের আগের বছরের সকল পাওনা পরিশোধ করার কথা বিনীতভাবে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়। এ উপলক্ষে নববর্ষের দিন তাদের মিষ্টিমুখ করান ব্যবসায়িরা। আগে একটিমাত্র মোটা খাতায় ব্যবসায়িরা তাদের যাবতীয় হিসাব লিখে রাখতেন। এই খাতাটি বৈশাখের প্রথম দিন নতুন করে হালনাগাদ করা হতো। হিসাবের খাতা হালনাগাদ করার এ রীতি থেকেই উদ্ভব হয় হালখাতার। একসময় বাংলা নববর্ষের মূল উৎসব ছিলো হালখাতা।
হালখাতার প্রস্তুতি
বাংলা পঞ্জিকা অনুযায়ী বছরের শেষদিন ধুঁয়ে-মুছে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে নানা জাতের ফুল, বেলুন, রঙিন কাগজ আর ‘শুভ নববর্ষ’, ‘শুভ হালখাতা’ লেখা ব্যানার-ফেস্টুনে সাজানো দোকান। নতুন বছরের জন্য কেনা হত নতুন খাতা, ক্যালকুলেটর, কলমসহ কত কি। আর নববর্ষের প্রথম দিনে দোকান খুললেই পুরোনো হিসাব চুকিয়ে নতুন খাতাদোকানের অবয়বে আনা হয় নতুনত্ব।
সেই সাথে রঙ বেরংয়ের বাহারী কার্ডের ব্যবস্থা করা হয়। কেউবা মুখে মুখেই দাওয়াত দিয়ে দেন। কার্ড দেয়া নেয়াটা তাদের কাছে মূখ্য বিষয় হয়ে উঠেনা। বিষয়টা সম্পর্কের। হোক ব্যবসায়িক নতুবা আত্মিক। ইদানিং মোবাইলে কল দিয়ে, মেসেজের মাধ্যমে, অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ইমোতে এসব দাওয়াতনামা পাঠান। সাধারণত মুসলমানদের নিমন্ত্রণপত্রে থাকে মসজিদের-মিনারের ছবি আর হিন্দুদের নিমন্ত্রণপত্রে মাটির পাত্রে কলাগাছের পাতা, ডাব এবং উপরে দেবতা গণেশের ছবি। মুসলমান ব্যবসায়ীরা ‘বিসমিল্লাহ’ কিংবা ‘এলাহি ভরসা’ আর হিন্দু ব্যবসায়ীরা এ দিন নতুন খাতার ওপর ‘গণেশায় নমঃ’ লিখে থাকেন। অর্থাৎ যে যার ধর্ম অনুযায়ী সৃষ্টিকর্তাকে স্মরণ করে নতুন খাতায় হিসাব হালনাগাদ করেন।
হালখাতার আয়োজন (অতীত থেকে বর্তমান)
নিয়মিত গ্রাহক, পৃষ্ঠপোষক ও শুভানুধ্যায়ীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকেন ব্যবসায়ীরা। হালখাতায় আগত অতিথিদের মিষ্টি মুখ করান। শুধু যে মিষ্টি মুখ তা কিন্তু না সাথে থাকে নানা রকম খাবারের ব্যবস্থা যেমন, রসগোল্লা, কালোজাম, সন্দেশ, বাতাসা, মন্ডা, জিলাপি, লুচি, পুড়ি, বুন্দিয়া, লাচ্ছা সেমাই, সুজি, হালুয়া, মুড়ি মুড়কি, দই, চিড়া, ভাতের সাথে ইলিশ মাছ, মাংস, মাছের মুড়িঘণ্ট, শরবত, বৈশাখী ফলমূল আর খাওয়া শেষে মিষ্টি পান। অনেক সময় দোকানের সামনেই কারিগররা নতুন চুলা বসিয়ে তৈরি করে গরম গরম জিলাপি, লুচি, বুন্দিয়া আর রসগোল্লা। খরিদ্দারদের গরম গরম মিষ্টি খাওয়ানোর উদ্দেশেই দোকানের সামনে এমন ব্যবস্থা করা হয়।
ইদানিং অনেকটা বদলে গেছে হালখাতার রীতিনীতি। মিষ্টির সাথে এখন নানা রকম আকর্ষণীয় ও রসনাদায়ক ভূড়ি ভোজের আয়োজন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের হালখাতা আর শহরের হালখাতার মধ্যে একটু ভিন্নতা দেখা যায়। গ্রামের হালখাতাতে ব্যবসায়ীরা বৈশাখের প্রথমদিনে সকালে এসে দোকান পরিষ্কার করে কাগজের ফুল দিয়ে সাজান বর্ণিল সাজে। শহরের ব্যবসায়ীরা হালখাতার দিনে নানা রঙের আলোকসজ্জায় দোকান সাজিয়ে থাকেন। তারা নামকরা অথবা পাশের কোনো মিষ্টির দোকানদারদের সাথে কথা বলে রাখেন। নামকরা বাবুর্চি দিয়ে তৈরি করেন পোলাও, বিরিয়ানী, তেহারী, জর্দ্দা, দধিসহ নানা খাদ্যসামগ্রীর। হালখাতার আয়োজক অতিথি অনুযায়ী বিভিন্ন রকমের নির্দেশনা দিয়ে থাকেন পরিবেশনকারীদের। আবার অনেক জায়গা দেখা যায়, হালখাতায় মিষ্টি মুখ করাতে ব্যবসায়ীরা প্যাকেটের আয়োজন করেন। যাতে মিষ্টি, জিলাপি ও নিমকীসহ বিভিন্ন রকমের প্যাকেজ থাকে। ইদানিংকালে দেখা যাচ্ছে হালখাতায় সর্বোচ্চ বিক্রেতাদের বিভিন্ন উপহারাদী প্রদান করার অঘোষিত রীতি। এছাড়াও এ হালখাতায় র্যাফেল ড্র’র মাধ্যমে আকর্ষণীয় পুরষ্কার প্রদান ও সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
চার দশক আগের হালখাতার স্মৃতি মনে করে আপ্লুত কন্ঠে ঘিওরের রাধাকান্তপুর গ্রামের মুন্নাফ মোল্লা বলেন, “ছোটবেলায় বাবার সাথে হালখাতা খেতে যেতাম। দোকানের সাজগোজ আর বাহারী মিষ্টির লোভ সামলাতে পারতাম না। তবে ডিজিটাল যুগে হালখাতার সেই অনুভূতিটা এখন আর ফুটে উঠে না। রঙিন কাগজের মালা, ফুল, জরির ঝালর দিয়ে সব দোকান সাজানো হতো। বাজারের একটা দোকানের সামনে কলাগাছের গেট তৈরি করে দেবদারু পাতা দিয়ে ছাওয়া হতো। তারই মাঝখানে রঙিন অক্ষরে লেখা ‘শুভ হালখাতা’। তারপর বাবার হাত ধরে প্রবেশ করতাম হালখাতার দোকানে। দোকানদার খুব আদর করে বসতে দিতেন। থালা ভর্তি মিষ্টি এনে সামনে ধরে দিতেন। এত মিষ্টি খেতে না পারলেও খুশি নেচে উঠলো মন।” তিনি আরও বলেন, “দেনা পাওনা মিটিয়ে বাবা বলতেন ছেলে হালখাতা চেনে না, বুঝেছ। হা হা করে খানিক হেসে আমাকে বলতেন বাবা এর নামই হালখাতা। খাও, মিষ্টি খাও। এর পর দোকান থেকে ওঠার সময় আরও এক প্যাকেট মিষ্টি ধরিয়ে দিতেন দোকানদার। না করেও রক্ষা হতো, দোকানদার নাছোড়বান্দা। হালখাতার মিষ্টি না নিলে তার দোকানের যে অকল্যাণ হবে। অতিথি দোকানে বসে খাবে, আর বাড়ির লোকেরা খাবে না, তাই কি হয়? বাঙালি হচ্ছে অতিথিপরায়ণ জাতি। অতিথিকে খাইয়ে-পরিয়ে সাধ মেটে না।”
হালখাতায় ব্যস্ততা
হালখাতাকে কেন্দ্র করে লাল মলাটের খাতা তৈরি ও বিক্রেতাদের দম ফেলার সময় থাকে না। চৈত্র মাসজুড়েই এসব পেশায় ব্যস্ত কারিগররা। মানিকগঞ্জ শহরস্থ রংধনু মাল্টিমিডিয়ার কর্ণধর শফিকুল ইসলাম সুমন বলেন, “প্রতিবছরই বাংলা নববর্ষের আগে দোকানদাররা লাল খাতা আর বাহারী ডিজাইনের দাওয়াত পত্র কিনতে ভিড় জমান। তবে আগের তুলনায় এখন অর্ডার অনেক কমে গেছে। কারণ এসব খাতার জায়গায় এখন ব্যবসায়ীরা কম্পিউটারে হিসাব রাখতে শুরু করেছে।
ঘিওর উপজেলার তরা এলাকায় অবস্থিত সেঞ্চুরি প্রোডাক্টস এর কারখানা মালিক মো. রাজা তালুকদার জানান, হালখাতার এক মাস আগে থেকেই সারাদেশ থেকে প্রচুর অর্ডার আসে দাওয়াতপত্র ও বিভিন্ন রঙের কার্ডের। এসব অর্ডার সময় মতো ডেলিভারি দিতে কারখানায় কর্মরত কারিগড়দের দম ফেলার সময় থাকে না। এছাড়াও হালখাতাকে ঘিরে ব্যস্ত সময় কাটান মিষ্টি ও দধির কারিগড়, কাগজের ফুল তৈরীর কারিগড় ও ডেকোরেশন কর্মীরা।
ঐতিহ্য হারাচ্ছে হালখাতা
বছর দশক আগেও খুব জাঁকজমকভাবে হালখাতা অনুষ্ঠানের আয়োজন চোখে পড়তো। সেই উৎসাহ-উদ্দীপনা এখন অনেকটাই কমে গেছে। হালখাতা বলতে আগে যেমনটি বোঝাতো এখন আর তা নেই। নিয়ম রক্ষার জন্য অনেকেই হালখাতা করেন। পুরোনো খাতার বদলে লাল রঙের নতুন খাতা কেনেন। অনলাইন কেনা-কাটায়, অনলাইন ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কাডের্র মাধ্যমে লেনদেন প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় কমে গেছে বাকি লেনদেনের পরিমাণ। আবার চাকরিজীবী থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী প্রায় সবাই ইংরেজি মাসের ওপর ভিত্তি করে আয়-ব্যয় করেন। ফলে পহেলা বৈশাখ অধিকাংশ ক্রেতা বকেয়া পরিশোধ করেন না। এসব কারণে ঐতিহ্যবাহী হালখাতার কৌলিন্য হারাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। ঐতিহ্য হারানোর কারণ প্রসঙ্গে ব্যবসায়ীরা জানান, বর্তমানে সর্বত্র ইংরেজি মাসের হিসাব-নিকাশ প্রচলিত হওয়ায় হালখাতার উদ্দেশ্য ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
এ প্রসঙ্গে মানিকগঞ্জের বানিয়াজুরীর অন্যতম ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মেসার্স দেশ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. লোকমান মোল্লা বলেন, “মূলত প্রতিবছরই হালখাতা উৎসব ঐতিহ্যগতভাবে পালন করি। কিন্তু ক্রেতাদের তেমন সাড়া পাওয়া যায় না। আর হালখাতা অনুষ্ঠানে বকেয়া আদায়ের পরিমাণটাও কমে গেছে অনেকাংশে। অনেকটাই নিয়ম রক্ষা কিংবা ঐতিহ্য রক্ষার জন্য এ হালখাতা করে থাকি।”
হালখাতার হাল আগের মতো না থাকলেও চিরায়ত এ অনুষ্ঠানটি কিন্তু হারিয়ে যায়নি এখনও। সার্বজনীন উৎসব হিসেবে ‘হালখাতা’ বাংলা নববর্ষের অন্যতম উপাদান। হালখাতার এই আতিথিয়তায় এক অন্য রকম তৃপ্তি; অন্য রকম স্বাদ, বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্য আর সম্প্রীতির প্রতীক। অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জীবনে হালখাতা উৎসব হোক সুখকর ও সমৃদ্ধময়। সমস্ত হিংসা ও বিদ্বেষ ফেলে আপন আলোয় আমাদের শুভবোধ, সত্য ও সুন্দর স্বপ্নরা হোক চিরজীবী। মিলে যাক আমাদের হালখাতার সকল হিসাব।