বেড়: একটি কৃত্রিম পানি প্রবাহের ও সংরক্ষণের পদ্ধতি

বারসিক ফিচার ডেস্ক::

বেড় বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের বৃহত্তর বরিশাল বিভাগে প্রচলিত একটি কৃত্রিম পানি প্রবাহের ও সংরক্ষণের পদ্ধতি। প্রায় ২০০ বছর পূর্বে এ পদ্ধতির সূচনা ঘটে। জোয়ারের পানির হাত থেকে নিজেদের নিচু ভুমিগুলকে রক্ষা করার চেষ্টা থেকে স্থানীয় জনগণ এই পদ্ধতির উদ্ভাবন ঘটায়। প্রাথমিক অবস্থায় তারা মাটি কেটে নিচু জমিগুলোকে উঁচু করে এবং এরফলে সৃষ্ট হওয়া গর্তগুলোতে জোয়ারের পানি জমা শুরু হয়। পরবর্তীতে তারা দৈনন্দিন ব্যবহার যোগ্য পানির যোগান নিশ্চিত ও সংরক্ষণ করা জন্য নানা রকম পরিবর্তন ও পরিশোধনের মাধ্যমে এ পদ্ধতির উদ্ভাবন করে। যা বর্তমানে বেড় নামে পরিচিত। বেড় শব্দের অর্থ পুকুর। বেড় মুলত একটি ছোট আকৃতির পানি প্রবাহের ধারা, যার গড় গভীরতা তিন থেকে পাঁচ ফিট,এর একমাথা সংযুক্ত থাকে কোন একটি খালের সাথে,খাল সংযুক্ত থাকে নদীর সাথে আর এভাবে নদীর পানি খাল হয়ে বেড়ের মধ্য প্রবাহিত হয়। বেড়ের পানি সবজী ক্ষেত,বাগান ও গৃহকর্মে ব্যবহার করা হয়। বেড়ের পানি সেচ কাজে ও ব্যবহার করা হয়। এছাড়া বেড়গুলো স্থানীয় পুকুরগুলোর সাথে ও সংযুক্ত থাকে। বৃষ্টির পানি বেড়ের মাধ্যমে পুকুরে সংরক্ষন করা হয়। বর্তমানে দক্ষিণ অঞ্চলের বরগুনা, পটুয়াখালি, পিরোজপুর, ঝলকাঠি জেলার সর্বত্র বেড়ের ব্যবহার রয়েছ।

[su_slider source=”media: 351,352,353″ link=”image”]

বেড়ের প্রকারভেদ

মানুষ প্রয়োজন,চাহিদা ও ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন প্রকার বেড় তৈরি করা হয়েছে। তবে সব বেড়গুলোকে মুলত তিনটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায় যথাঃ

ভিটে বেড়

ভিটে শব্দের অর্থ হচ্ছে বসত ভুমি ,তাই বসত ভুমির চারপাশ পরিবেষ্টিত অবস্থায় যে বেড়ের অবস্থান তাকে ভিটে বের বলে।নিজেদের ভিটে বাড়িকে জোয়ারের পানি থেকে রক্ষা করার জন্য মানুষ তাদের বসত ভুমির চারপাশ থেকে মাটি খনন করে বসত ভুমি কে উঁচু করে। এরফলে বসত ভুমির চারপাশে যে নিম্ন জলাশয়ের সৃষ্টি হয় তাই পরবর্তীত ভিটে বেড়ের আকার ধারন করে।দৈনন্দিন গৃস্থথালির নানা কাজে এই বেড় ব্যবহার করা হয়।

বাগান বেড়

স্থানীয় লোকজন তাদের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করার জন্য বেড়ের উপর নানারকম গাছের বাগান করা শুরু করে। পরবর্তীতে এই বাগানগুলো আরও সুশৃংখল ভাবে করা হয় এবং বাগানগুলোতে সর্বক্ষনিক পানি সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য তারা আলাদা করে বেড় খনন করে।এই বেড়ই বাগান বেড় নামে পরিচিত।বাগানে গাছগুলো কয়েকটি সারিতে রোপন করা হয় এবং প্রতি দুটি সারির মাঝখানে একটি করে বেড় খনন করা হয়। এই বেড়গুলোতে পানি প্রবাহ নিশ্চিত করার জন্য কোন খাল অথবা পুকুরের সাথে সংযুক্ত করা থাকে। বেড়গুলো পানি সরবরাহের পাশপাশি বাগানে জমিকে ও উঁচু করে।

কৃষি বেড়

কৃষি কাজে সহায়তা করার জন্য কৃষি জমির পাশে যে বেড় খনন করা হয় তাকে কৃষি বেড় বলে। এই বেড় কৃষি জমির সাথে পাইপ লাইন অথবা ছোট ছোট নালার মাধ্যমে সংযুক্ত থাকে। সাধারণত এই বেড় জমিতে সেচ কাজে সহায়তা করে,এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে বীজ তলা তৈরী করতে বেড়ের পানির ব্যবহার করা হয়। কৃষি বেড়ের আরেকটি রূপ হচ্ছে সবজী বেড়। এই বেড়ের উপড় ভিত্তি করেই এর চারপাশে সবজী ক্ষেতগুলো গড়ে উঠে। আবার এই বেড়ের উপর মাচা করে ও সবজী চাষ করা হয়।সবজী চাষের জন্য প্রয়োজনই পানি এখান থেকে সরবরাহ করা হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই বেড় গুলোতে মাছের ও চাষ করা হয়ে থাকে।

বেড়ের কার্যপ্রনালী

বেড় মুলত একটি ছোট আকৃতির কৃত্রিম খাল,যার প্রধান কাজ হচ্ছে ব্যবহার যোগ্য পানির যোগান নিশ্চিত করার জন্য নদীর পানিকে মূল ভূ-খন্ড দিয়ে প্রবাহিত করে নিদিষ্ট স্থানে পোছে দিয়া। বেড়ের পানির প্রধান উৎস নদী হলে ও বেড়গুলো সরাসরি নদীর সাথে যুক্ত থাকে না। বেড় সংযুক্ত থাকে খালের সাথে আর খালের সাথে সংযোগ থাকে নদীর,এভাবে নদীর পানি খাল হয়ে বেড়ের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়। বেড় ও খালের সংযোগস্থলে একটি পাইপ বসান থাকে যা দ্বারা পানি খাল থেকে বেড়ে প্রবেশ করে। আবার এক বেড় থেকে পানি অন্য বেড়ে ও প্রবাহিত হয়।এভাবে পানি ভিটে বেড়, কৃষি বেড় ও বাগান বেড়ে প্রবাহিত হয়। এছাড়া বেড়ের সাথে পুকুরের সংযোগ করা থাকে ফলে পুকুরে কখন পানির ঘাটতি দেখা দেয় না। বৃষ্টির পানি ও বেড়ের মাধ্যমে সংরক্ষন করা হয়।

বেড়ের ব্যবহার

যুগ যুগ ধরে প্রচলিত বেড় পদ্ধতি স্থানীয় জনগনের জীবন যাত্রার সাথে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে আছে। তারা বেড়কে জীবন যাত্রার নানা স্তরে বিভিন্ন ভাবে ব্যবহার করে থাকে।

গৃহস্থালির দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার যোগ্য পানির অন্যতম উৎস হচ্ছে বেড়। প্রধানত ভিটে বেড় গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করা হয়। খাবার পানি ব্যতিত অন্যান্য কাজে স্থানীয় লোকজন বেড়ের পানি ব্যবহার করে। বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলের (বরগুনা, পটুয়াখালি, পিরোজপুর,) জেলার পানিতে লবনাক্তার হার অনেক বেশি, যা কৃষি কাজের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই কৃষি কাজে ক্ষেত প্রস্তুতি থেকে শুরু করে বীজ তলা তৈরি,বীজ রোপন,সেচ ও পরিচর্যা সকল কাজে এই অঞ্চলের কৃষকরা বেড়ের উপর নির্ভরশীল থাকে।এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে বীজ তলা তৈরী করতে প্রয়োজনিই পানি বেড়ের থেকে ব্যবহার করা হয়।

কৃষি কাজের জন্য অপরিহার্য উপাদন হচ্ছে সেচ দেওয়া,আর সঠিক ভাবে সেচ দেওয়ার জন্য স্থানীয় কৃষকরা সম্পুর্ণভাবে বেড়ের উপর নির্ভরশীল। এছাড়া বেড় থেকে শুষ্ক মৌসুমে ও পানি পাওয়া যায়। বেড়ে পানির মূল উৎস হচ্ছে নদী। নদীর পানি খাল হয়ে বেড়ে প্রবেশ করে।একই ভাবে নদীর মৎস সম্পদের কিছু অংশ খাল হয়ে অবাধে বেড়ের মধ্য প্রবেশ করে থাকে। এভাবে বেড়গুলো স্থানীয় জনগনের মাছের চাহিদা পুরণে বিশেষ ভুমিকা পালন করে।

স্থানীয় গাছের বাগানগুলো বেড়ের উপড়ই গড়ে উঠে। বাগানগুলোতে সবসময় পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা ও অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশন করার জন্য বেড় ব্যবহার করা হয়। বাড়ির আশে পাশে চাষ করা সবজী বাগানগুলো মুলত একটি বেড়কে কেন্দ্র করে এর চারপাশে গড়ে উঠে। সবজী বাগানগুলোর জন্য প্রয়োজনই পানির প্রধান উৎস হিসাবে এই বেড়কে ব্যবহার করা হয়। আবার সবজী বাগানের জমি উঁচু করার জন্য এবং এতে সুষ্ট পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য ও বেড় ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এই বেড়ের উপর মাচা করে ও সবজী চাষ করা হয়।

উপসংহার

বিরূপ প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকা মানুষের পক্ষে খুবই কষ্টকর। তাই মানুষ চেষ্টা করে প্রকৃতির সাথে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে প্রকৃতির মাঝেই বেঁচে থাকার ।আর একাজের অন্যতম বড় উদাহরণ হচ্ছে বেড়। তাইতো জোয়ারের পানির হাত থেকে নিজেদের নিচু ভুমিগুলকে রক্ষা করার উদ্দেশে স্থানীয় জনগণ যে বেড় পদ্ধতির উদ্ভাবন করে ছিল, আজ সেই বেড়ই তাদের জীবনযাত্রার অন্যতম উপাদান হিসাবে বিবেচিত হয়। বেড় পদ্ধতি তাদের জীবনযাত্রা কে অনেক সহজ করে দিয়েছে। এ পদ্ধতিতে তাহারা শুধুমাত্র তাদের নিম্ন আবাস ভূমিকেই উঁচু করেনি, খাদ্য উৎপাদন, মাছ ধরা, বাগান তৈরি সহ নানারকম কাজে এ পদ্ধতি ব্যবহার করছে। তাই বলা যায় একসময় যে বিশাল পানি প্রবাহ বৃহত্তর বরিশাল অঞ্চলের মানুষের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, আজ তাই তাদের বুদ্ধি,চেষ্টা ও পরিশ্রমের কারণে সুফল বয়ে আনছে।

happy wheels 2

Comments